আমার হাতে তালোয়ার ঝিকিমিকি করে, দেখি কোন শালা আমাকে মারতে পারে, মারতে পারে, মারতে পারে... এক নিঃশ^াসে লাইনটা আওড়িয়ে যাচ্ছে সোহেল। তাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মজনুর দলের ছেলেপেলেরা। বয়েস সবার এগারো কি বারে। সোহেলকে ধরতে পারে না কেউই; যেন মানবরুপি একটা বাজপাখি। এক দৌড়ে প্রতিপক্ষের তিনজনকে মাঠছাড়া করে তবেই ফিরেছে। মজনুর দল দূর্বল হয়ে পড়েছে। দুর্বল হলেও করার কিছুই নেই; পাল্টা আক্রমণ তাদের করতেই হবে। কিন্তু কে যাবে পাল্টা আক্রমণে; মজনুর বেজায় সাহস; শক্তিও একেবারে হাতি সমান তবে পা একটা খাটো হওয়ায় দৌড়ে বারবার মার খেতে হয় তাকে। গলার তাবিজে চুমু খেয়ে দৌড় শুরু করে মজনু। ঘাড়ের রগে ঘামের শিশির, জানে একবার ধরাশায়ী হলে ফিরে আসা কঠিন হবে। ফলাফল নির্ঘাত হার। খুড়িয়ে দৌড়ে মজনু; মুখে কাটে শ্বাস ধরার মন্তর, হা ডু ডু লটকন, তোরে মারতে কতক্ষণ, তোরে মারতে কতক্ষণ, তোরে মারতে কতক্ষণ...। পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয় ইয়াসমিন; সোহেল আর মজনুর আদরের ছোটবোন।
ওসমান গলিতে বিকেলবেলার এই চিত্র প্রত্যাহিক। সুর্য মামা মধ্যগগন অতিক্রম করে পশ্চিমে হেলতে শুরু করার আগেই গলির মুখে হাজির হয় বস্তির টেবলেট, ক্যাপসুলগুলো। আজগর মামা বলে, বিটিশ পোলাপাইন। সন্ধ্যা ঢলে কাকের আহাজারি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে বিচ্ছুদের হা ডু ডু, দাড়িয়াবন্দা, ডাঙগুলি কি গোল্লাছুট। কানামাছি আগে হত এখন হয়না। কানা হয়ে অনেকেই নালায় পড়ে; এরপর বস্তি জুড়ে নালার গন্ধ মৌ মৌ করে। বস্তির নালায় যে কত রকমের রোগ বসবাস করে তার ইয়ত্তা নেই। অনেকটা সমন জারি করেই বন্ধ করা হয়েছে কানামাছি খেলা। এমন চিপা গলিতে এই খেলা মানায় না। ইয়াসমিনও বান্ধবীদের সাথে সাতচাড়া, কুতকুত, পাঁচগুটি খেলে। যেদিন কেউ আসে না সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুই সহদরের খেল নৈপূণ্য দেখে আর হাততালি দেয়।
সাত বাই সাত সাইজের ছোট্ট কামরায় থাকে শরিফুদ্দিন; ইয়াসমিনের জন্মের সময় ইহলোক ত্যাগ করে তাকে সংসার সাগরে ভাসিয়ে গেছে। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে অন্ধকার সাঁতরে বেড়ায় এখনো। সোহেল আগে ইস্কুলে গেলেও এখন সেটাও বন্ধ করতে হয়েছে। মজনু গায়ে গতরে বড়ো হলেও মানসিক বিকাশ হয়নি। আর ইয়াসমিনের তো এখনো দুধের দাঁত পড়েনি। ঢাকা শহরের এই এলাকাতে যে কীভাবে থিতু হয়েছে সেটাও বিস্মৃত হতে বসেছে। সংসার সামলিয়ে অন্য কিছু মাথায় রাখা দূরহ হয়ে পড়ে তার পক্ষে। সোহেলকে কোনোরকমে কোনো একটা হাতের কাজে দিতে পারলে সংসারের হাল কিছুটা ফিরবে বলে মনে করে শরিফুদ্দিন। এই ছোট্ট ছেলেকে কাজে পাঠাতেও মন সাঁই দেয়না। আবার না দিলেও নয়। চার চারটা পেটের সংসার তার সামান্য আয়ে চলা কঠিন। ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকানো যায় না। ছোট্ট মেয়ের কোনো কিছুতে বায়না নেই; গায়ে নতুন জামা নেই, পায়ে কোনো চটি নেই, মাথায় নেই কোনো রঙ বেরঙের ফিতে; এতকিছুর পরও মুখে কোনো অভিযোগ নেই। যা আছে তাতেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অকৃত্রিম চেষ্টা করে যাচ্ছে মেয়েটা। কষ্ট হয় শরিফুদ্দিনের। চোখ বুজলেই পানি বের হয়। নোনতা পানি। অন্ধকারে ভেসে উঠে শামিনার মুখ। শামিনা, ওকে তিনবার কবুল বলে নগদ বিশ হাজার টাকা দেনমোহরে ঘরে তুলেছিল। মাগিটা সব ডুবিয়ে একা বেঁচে মরল। শালী স্বার্থপর, চরম স্বার্থপর। চোখের জলের ধারা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। ইয়াসমিন এসে কোলে বসে। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শরিফুদ্দিন পৃথিবীতে স্বর্গসুখ অনুভব করে। দুহাতের বাহুতে ইয়াসমিনকে জড়িয়ে ধরে। শামিনাকেও এক কালে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরতো সে।
সন্ধ্যা নামিয়ে ঘরে ফিরে সোহেল, মজনু। আজকের আয় দিয়ে কিছু সবজি নিয়ে এসেছে শরিফুদ্দিন। ছোট মাছও আছে এক ভাগা। শেষ কবে মাছ খেয়েছে কারোর মনে পড়ে না। তাই আজ মাছ দেখে চোখ চকচক করে উঠলো মজনুর। রান্নার ভারও তার উপর। এতটুকু ছেলে দারুণ রান্না করে। ওর হাতে শামিনার প্রভাব আছে। সামান্য নেড়েচেড়ে ঘেঁটে দিলেও অমৃত হয়ে উঠে। সোহেল পাটি বিছিয়ে বসেছে, পাতলা রাঙতা কাগজ, আঠা আর কাঠি নিয়ে এসেছে ইয়াসমিন। বাবাকে নিয়ে কালকের জন্য কাঠি খেলনা আর কাগজ পাখি বানাবে; বাহারি ভ্যাঁপু, চড়কাটা পুতুল, প্লাস্টিকের গোল পাখা, হরেক রঙের চুড়ি, বেলুনের বাঁশিও থাকে; চকবাজারে সস্তায় কিনে আনে শরিফুদ্দিন। এগুলো বিক্রি করেই যা আয় তাতে এই চারজনের দিনাতিপাত হয় কোনোরকমে। যেদিন ব্যবসা মন্দা যায় সেদিন ভাত জোটে না কারোর কপালেই। তবে বৈশাখের শুরুতে ব্যবসাটা ভালোই গেছে। পয়লা বৈশাখে বিক্রি বাট্টা যা হয়েছে তাতে ভালো মন্দ কিছুটা জুটেছে সবার কপালে। ইয়াসমিনও ভীষণ খুশি এই কদিনে। রাত বাড়তে থাকে, সবার হাত চলতে থাকে, কাঠি খেলনা আর কাগজ পাখি তৈরি হতে থাকে।
রাত গভীর হয়। ছেলেমেয়ে নিয়ে বহুকাল বাদে কবজি ডুবিয়ে রাতের খাবার খেল শরিফুদ্দিন। মেয়ে তার ভীষণ খুশি। তক্তাপোষের ওপর বাবার ওমে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন বুনে ইয়াসমিন। পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন; অধরাকে ধরার স্বপ্ন; নতুন জামার স্বপ্ন; নতুন জুতোর স্বপ্ন; বিলকিসের মতো স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন। শরিফুদ্দিন বুঝতে পারে মেয়ের বুকে হৃদয়ের অনুরণন। কম্পিত আঙুলের ছোঁয়ায় বিলি কাটে ছোট্ট পরীর এলোচুলে। ফিসফিস করে বলে, ‘মারে কী ভাবস অত?”
ইয়াসমিন গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে মা হেলায়; মুখে কিছু বলে না। সে জানে তার সব স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। তবুও স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নেই তো মানুষের আশা জেগে থাকে; এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা থাকে। শরিফুদ্দিন বলে, ‘চিন্তা করিস না মা; দেখিস আমাগো এই দিন আর বেশি থাকবো না।”
ইয়াসমিন ফিস ফিস করে বলে, ‘আব্বা আমারে না লাল ঝুটির পুতুল কিন্ন্যা দিবা কইছিলা, কবে দিবা?”
অনেকদিন ধরেই মেয়েটা একটা পুতুলের বায়না করছে। ছোট বেলা থেকে কোনো কিছুরই বায়না করে না; কিন্তু একটা পুতুল কিনতে যে টাকা লাগবে তা তো জোগাড় করতে পারে শরিফুদ্দিন। দীর্ঘশ্বাসে ঘর গরম হয়ে ওঠে। মুখে বলে, ‘দিব দিব মা, এই তো আর কটাদিন; ব্যবসা তো আল্লাহ্র রহমতে ভালা যাইতেছে। কাইলকে ব্যবসা ভালা অইলে তোর লাইগ্গ্যা একখান নাল পিরানের পুতুল কিন্ন্যা আনুম।”
চকচক করে উঠে ইয়াসমিনের চোখ, ‘সত্যই আনবা বাজান?’
শরিফুদ্দিন মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘আনুম কইলেম তো; অহন ঘুমাইয়া পড় দেহি...’
বাবার কথায় আশ্বস্ত হয় ইয়াসমিন; ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা উজ্জ্বল হয়। স্বপ্ন দেখতে শুরু করে আবার। কখন যে ঘুমের দেশে রাজপুত্তুরের সাথে দেখা হয় টের পায় না কেউই। পক্ষীরাজের পিঠে চেপে রাজ্য ঘুরে বেড়ায় রাজপুত্তুর। ঘুরতে ঘুরতে ইয়াসমিনের সাথে দেখাও হয়ে যায়। প্রথম দেখাতে বন্ধুত্বও পেতে বসে দুজন। রাজপুত্তুর পক্ষীরাজের পিঠে চাপিয়ে ইয়াসমিনকে নিয়ে যায় তার প্রাসাদে। এমন প্রাসাদ আগে দেখেনি সে। কত্ত বড়ো প্রাসাদ! এই প্রাসাদের প্রক্ষালন কক্ষও তাদের বস্তির যেকোনো ঘরের চেয়ে বড়ো। অবাক চোখে ঘুরে ঘুরে তাকায় ইয়াসমিন। যতই দেখে ততই মুগ্ধ হয়, অবাক হয়। রাজপুত্তুর ইয়াসমিনকে নিয়ে যায় তার ঘরে; চারদিকে দুনিয়ার অত্যাশ্চর্য্য খেলনায় ভর্তি। বাবার সেই নাল পিরানের পুতুলও আছে। কী সুন্দর দেখতে! পুতুলের মাথায় হাত বোলায় ইয়াসমিন। পুতুল হেসে ওঠে। বলে, তুমি কি আমার বন্ধু হবে? ইয়াসমিন খুশিতে ডগমগ হয়ে জড়িয়ে ধরে লাল পিরানের পুতুলকে। মুখে বলে, আমার লক্ষ্মী লাল পিরানের সই। তোমার পিরানখান কত্ত সুন্দর, একদম রাইজকইন্ন্যের লাহান!
স্বপ্নের কথা মুখে আওড়াতে থাকে ঘুমন্ত ইয়াসমিন। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে উচ্ছ্বাসের ছাপ। শরিফুদ্দিন মেয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের অপারগতার কাছে অসহায় মনে হয় তার; ভাবে, কালকেই একটা পুতুল আর একটা লাল টুকটুকে ফ্রক কিনে আনবে; মেয়ের স্বপ্ন সত্যি করবে। পাশে অঘোরে ঘুমায় সোহেল, মজনু। বাবার বুকে মুখ গুঁজে থাকে ইয়াসমিন।
ঘুম গড়িয়ে সকাল হয়। রাতে বানানো কাঠি খেলনা আর কাগজের পাখি বাঁশের ফ্রেমে তৈরি মাচায় সাজাতে থাকে। চকবাজারের রেডিমেড খেলনা আগেই সাজানো হয়েছে; শহর ঘুরে ঘুরে এই কাঠি খেলনা আর কাগজের পাখি পৌঁছে যাবে ময়না, টিয়ে, দোয়েলের সংসারে; ইয়াসমিনের মতো বাচ্চারা সে খেলনা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হবে। কাগুজে পাখি উড়িয়ে পাড়া এক করবে। শরিফুদ্দিনের পকেটে আসবে কিছু কাঁচা পয়সা। সে পয়সায় কেনা হবে মেয়ের জন্য একখানা ছোট্ট নাল পিরানের পুতুল। শরিফুদ্দিন হাতের জোর বাড়ায়। কাঁধে বাঁশের ফ্রেম ভর্তি খেলনা নিয়ে বের হয়ে পড়ে একবুক স্বপ্ন নিয়ে। হালকা হাওয়া পেতেই ঘুরতে শুরু করে লাল নীল প্লাস্টিকের পাখাগুলো। পেছন থেকে দেখলে শরিফুদ্দিনকে শহরে রঙের ফেরিওয়ালা মনে হয়। রঙিন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
শহর ঘুরে শরিফুদ্দিনের পায়ে। পিছঢালা রাজপথে পায়ে পায়ে দিন গড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণপর বৈশাখ মাসের তেজস্বী সূর্যটা নিস্তেজ হয়ে বিকেলের সোনা ঝরা রোদের পসরা সাজাবে। মানুষজন গরমের তীব্রতা কাটিয়ে ঘরের বাইরে আসবে; মাঠে ময়দানে ছড়িয়ে যাবে এই শহরের খোপ বন্দি মানুষগুলো; যারা একটু সতেজ হাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে বেড়ায় রোজ। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বের হয়ে পড়ে একটু শান্তির খোঁজে, একটু সতেজতার খোঁজে, একটু নির্মলতার খোঁজে। শরিফুদ্দিন সেসব বাচ্চাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাচ্চারা বায়না করে কাঠি খেলনা কিনবার, কাগুজে পাখি কিনবার, হরেক রঙা চুড়ি কিনবার, লাল নীল পাখা কিনবার। বাবা-মা অগত্যা পকেট হাতরিয়ে সন্তানের মন জয় করবে। একপকেটের টাকা যাবে আরেক পকেটে।
শরিফুদ্দিন এই সময়টায় কোনো ফাঁকি দেয় না; সাধ্য মতো চেষ্টা করে যায়, যেন সর্বোচ্চটা আয় করতে পারে। তার চেষ্টায় কখনো সখনো সফলও হয়, সে জানে যে নিজেকে সাহায্য করে আল্লাহ্ স্বয়ং তাকে সাহায্য করে; যে কিছু করার চেষ্টা করে তার দিন বদলাতে সময় লাগে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই পাশটায় বিকেল বেলায় মানুষের সমাগম ভালোই হয়। অরণ্যে ঘেরা সবুজের সমারোহ এই উদ্যানের চারপাশ। মাঠের পাশেই ইয়া বড়ো স্বাধীনতা স্তম্ভকে ঘিরে রেখেছে কৃত্রিম লেক। লেকের ওপর উড়ে বেড়ায় শতশত শহুরে চিল। গরমের তাপে অতিষ্ট হয়ে তারাও নেমে আসে লেকের জলে; জলকেলি করে আবার উড়ে যায় আকাশে। এই দৃশ্য বড়োই মনোরম, দৃষ্টিনন্দন, মনলোভা। ছোট ছোট বাচ্চারা এত কাছ থেকে চিল দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়। শরিফুদ্দিনের থেকে কেনা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে আনন্দ উদযাপন করে ওরা।
আজ বিকেলও এসেছে স্বপ্নকে ধরার ইঙ্গিত দিয়ে। রৌদ্রের প্রখরতাও অন্যদিনের মতো অতটা নয়। বিকেল হতেই উদ্যানে দলে দলে ভিড়ছে লোকালয়ের মানুষগুলো। চাওয়ালারা দাপটে ফেরি করে চলেছে। এক কাপ রঙ চা দশ টাকা! ভাবা যায়! অথচ সে এত কষ্ট করে খেলনা বানিয়ে, পুঁজি খাটিয়ে বিক্রি করে কিনা সবে পনের টাকায়! লাভ যে সে করে না তা নয় কিন্তু চাওয়ালাদের এই আয়কে রীতিমতো ছিনতাই মনে হয় তার। পাবলিকও খায়! এখানে যারা আসে তাদের সিংহভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের আদম সন্তান। আশ্চর্য্য হলেও এটাই সত্যি যে দুনিয়াতে মধ্যবিত্ত মানুষগুলো নিজেকে যতটা গরীব, সম্বলহীন বলে যাহির করে প্রকৃতপক্ষে তারা ততটাও খারাপ অবস্থায় থাকে না অথবা প্রকৃতপক্ষে যতটা নিঃস্ব ততটা দেখায় না; তাই যদি না হয় তবে দশটাকা দিয়ে এই মানহীন চা খাবেই বা কেন? মধ্যবিত্তরা বেশ নাটুকে হয়। পাক্কা অভিনেতা। অভিনয় করেই এদের জাত বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এরচেয়ে অতি ধনী আর অতি গরীবরাই উত্তম; অভিনয় করতে হয় না ওদের।
ভাবতে ভাবতে নিজের সংবিৎ হারিয়ে বসে শরিফুদ্দিন। লেকের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। কাঁধে বাঁশে ফ্রেমে বাঁধা কাগুজে পাখিরা কিচিরমিচির করে ডাকে। যখন শরিফুদ্দিন চমক ফিরে পায়, মাঠ জুড়ে সমাবেতরা হুড়োহুড়ি মাচিয়ে দিগবিদিগ দৌড়াচ্ছে। ছোট্ট ছেলের মাথায় আঁচল দিয়ে দৌড়ায় মা; কিশোরের হাত ধরে দৌড়ায় বাবা, প্রিয়তমার হাত ধরে দৌড়ায় প্রিয়, পাখিরা উড়ে চলে উদ্দেশ্য জ্ঞানশূণ্য; একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে সবাই! প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে উদ্যানে, ধূলো ঝড়। শরিফুদ্দিন সর্বশক্তিতে আঁকড়ে আছে বাঁশের ফ্রেম। কাঁধে ফ্রেম চাপিয়ে এমন বাতাসে এককদমও দেওয়া যায় না। কাগুজে পাখিরা মুক্তির জন্য ডানা ঝাপটায়। মুহূর্তের ব্যবধানে আকাশ কালো হয়ে উঠলো। ঘন মেঘে ছেয়ে গেছে চারপাশ। পবনদেবের আক্রোশে ধূলিময় হয়ে উঠেছে সমগ্র উদ্যান। সারি সারি পামগাছ মাথা নূয়ে সালাম ঠুকে যায় প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কাছে। চিলগুলো ইউক্যালিপটাসের মগডাল এমনভাবে আঁকড়ে ধরে আছে যেমনটা বিদায়ের সময় কন্যা তার পিতাকে আঁকড়ে ধরে থাকে; বুকের মধ্যে হৃদপিন্ডটা দূরুদূরু করে ওঠে কোনো এক অজানা আশঙ্কায়। শরিফুদ্দিনের চোখে নেবা ধরেছে; কিছুই দেখা যাচ্ছে না; এমন কাল বৈশাখির ঝড়ে শহরের রঙগুলো মলিন হয়ে উঠেছে নিমেষেই; বাঁশের ফ্রেমে বন্দি কাগুজে পাখি দড়ি ছিঁড়ে উড়ে যেতে থাকে; উড়তে উড়তে কিছুদূর গিয়ে থমকে পড়ে। কাঠি খেলনাগুলো ডমরু ডঙ্কা হয়ে বেজে ওঠে; বাঁজতে বাঁজতে ক্লান্ত হয়ে ভেঙে পড়ে মাটির বুকে। প্লাস্টিকের পাখাগুলো মুহূর্তেই টর্নেডো হয়ে যায়; উড়তে ঘুরতে চিলের সামনে ঠাট্টা করে; একগাল হেসে উড়ে যায় ভাবনাতীত উচ্চতায়। শরিফুদ্দিন বুঝতে পারে হরেক রঙা পাখাগুলো তার স্বপ্ন নিয়ে উড়ে চলে যায়; ইয়াসমিনের স্বপ্ন নিয়ে উড়ে চলে যায়; নাল পিরানের রাজকইন্ন্যের স্বপ্ন নিয়ে উড়ে চলে যায়; পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে আসা রাজপুত্তুরের স্বপ্ন নিয়ে উড়ে চলে যায়।
তা-ব চলে, ভয়ংকর তা-ব চলে, প্রকৃতি নিজের রুপে প্রলয়ঙ্করি হয়ে ওঠে। অঝোরে ঝরে পড়ে ঘনীভুত মেঘমালা। ইয়াসমিনের স্বপ্ন সমাধিস্থ করার সকল পরিকল্পনা নিয়েই হাজির হয়েছে আজকের ভয়ংকর অন্ধকার নামানো বিকেল। অথচ এই বিকেলে সোনা রোদ খেলার কথা মাঠের চারপাশে। ঝড়ের তালে শরিফুদ্দিন যতই এক পা দু’পা এগিয়ে যায়; ভাগ্য ঠিক ততটাই তাকে পেছনে ঠেলে দেয়। যখন স্বপ্ন চুরি করে উধাও হলো তা-বী বৈশাখ, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শরিফুদ্দিন। মুখে আর্তচিৎকার ফুটে ওঠে, ‘নাল পিরানের পুতুল, আমার ইয়াসমিনের পুতুল, নাল পিরানের পুতুল; পাইরলাম নারে মা, আমি পাইরলাম না তোর স্বপ্ন পূরণ কইত্তে..’
যখন শরিফুদ্দিন বাড়ি ফিরে আসে ইয়াসমিন বুঝতে পারে তার স্বপ্ন উড়ে গেছে। বাবার ওপর ঝড় বয়ে গেছে। প্রচন্ড ঝড়। এমন ঝড়ে ঝরে গেছে স্বপ্নবৃক্ষের পাতাগুলো, এমন ঝড়ে উড়ে গেছে পুতুলের নাল পিরান। বাবার বুকে মুখ গুঁজে থাকে ছোট্ট ইয়াসমিন। সোহেল দৌড়ে আসে। শরিফুদ্দিনকে কদমবুসি করে বলে, ‘আব্বা রহমত চাচা কইলো কাইল থেইকা হের কারহানায় যাইতে; একশ টেহাও দিছে।’
হাতে থাকা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট বোনের দিকে এগিয়ে দেয় সোহেল। প্যাকেট খুলতেই চোখ দুটো চকচক করে উঠে ইয়াসমিনের। আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠে বলে, ‘নাল পিরানের পুতুল!’
শরিফুদ্দিনের মনে পড়ে কোনো এককালে রহমতের ঘোর বিপদে সাহায্য করেছিল। দু’হাত তুলে বলে, ‘আল্লাহ্, তোমার খেল বোঝা বড়ো দায়..;’
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন