(১)
জয়ীতা মির্জা রবার্টস এর জানালায় সবুজ সংকেত দেখতে পেয়ে মিলি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাসফেললো যাক, সে এখন অনলাইনে আছে। মিলি সন্তানদের পইপই করে শিখিয়েছেন, ‘তোমরা বড় হয়েছোযেখানেই থাকো, যাইকিছু করো, ভাল কিছু করছো, ভাল আছো, এই সংবাদটুকুতেই আমার শান্তি!’
মিলি দ্রুত একটা টেক্সট পাঠালেন জয়ীতাকে।
‘কিরে মা, কেমন আছিস? কোথায় তুই?’ সাথে সাথেই মিলির স্ক্রীনে টাইপিংয়ের বুঁদবুঁদ ভেসে উঠল। মিলি আগ্রহভরে সেই বাবলের দিকেতাকিয়ে রইলেন।
‘হাই মম, ডোন্ট অরি; আই’ম গুড। আই’উইল কল ইউ সুন!’
‘আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। তোর মনে আছে? আজ একটা অনুষ্ঠানে যাবো। তোর বাবাকে নিয়ে কথা বলবো! ‘
‘হাউ সুইট! অবশ্যই বলবে মম।মাই বাবা ইজ অ্যা হিরো। আই’ম ভেরি প্রাউড অফ হিম। বাঙালিদের অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য সন্মান দেয়া উচিত মা। বাট, দলাদলি, কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের সন্মানটাও বজায় রাখা উচিত। আই মীন ইট!’
‘তাতো বটেই। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ। এই স্বাধীনতা। সন্মান তাদের অবশ্যই প্রাপ্য।’
মিলি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হয়েও নিজদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে প্রকাশ্যে দুটো কথা বলার বা লেখার সাহস তার আজও হয় না। বহুদিন ধরেই শুরু হয়েছে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে দড়ি টানাটানি। এখনতো সরকারের সমালোচনা করলে,সত্য কথা বললেই, তারনামে জাতির পিতা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তকমা জোটে। চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলতে হয়। লিখতেহয় কলম দমিয়ে। ঘরোয়াভাবে, বন্ধুমহলে যা বলা যায়, সেইসব কথা পাবলিকলি বলা বড় কঠিন।
মিলি ঠিক করলেন, অনন্ত এই বিশেষ দিনটিতে, তিনি কোনরকম হতাশাকেই প্রশ্রয় দেবেন না। মিলিআলমিরা খুলে সবুজ তসরের শাড়িটার সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ এবং পেটিকোট বের করলেন। আজকে সবাই লাল-সবুজ শাড়ি পরবে। শাড়িটা আইএসপি থেকে কেনা গাঢ় সবুজ জমিনে সরু সোনালী পাড়, সাথে লালের উপর সোনালী চমৎকার কাজ করা কাতানের আঁচল। তৈরি হওয়ার আগে তিনি বাথরুম থেকে দাঁত ব্রাশ করে, হাতমুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে এলেন। মুখে ফেইসক্রীম লাগিয়ে, চুলে চিরুনী চালালেন কিছুক্ষণ। যত্ন করে শাড়ি পরলেন। রেশমের মত মসৃন চুলগুলো এলো করে পিঠে ছড়িয়ে দিলেন।
সাজগোজের ব্যাপারে মিলি বরাবরই খুব মার্জিত। মুখে কমপ্যাক পাউডার, চোখে কাজল, ঠোঁটেলিপস্টিক, কপালে টিপ। তবে টিপে রকমফের তার ভাল লাগে। কখনও ছোট্ট একটা বিন্দু, কখনও সূর্যেরমত বড়, কখনও নিজের হাতে আঁকা টিপ। কিন্তু রিচার্ডের সাথে বাইরে গেলে তখন পুরো দস্তুর পশ্চিমাসাজ। রিচার্ডের পছন্দ-অপছন্দের মুল্য দিয়ে তার নিজের স্টাইলে, সাজসজ্জায় মানানসই বৈচিত্র এনেছেমিলি। কেন নয়? এই মানুষটা পাশে না থাকলে, আজ কোথায় ভেসে যেতো মিলি সুলতানা। কেউ তারখোঁজও জানতো না।
বাংলাদেশের অজ পাড়াগাঁয়ের মিলিকে রবার্টস পরিবারের বউয়ের মর্যাদা দিয়ে আমেরিকার মত দেশে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এই মানুষটি। শরীরে এই মানুষটার হাতের ছোঁয়া পেলে এই বয়সেও মিলির বুকের ভেতরেরক্তের গতি বেড়ে যায়। গাল রক্তিম হয়ে ওঠে। মিলির মুখের হাসিটুকু ধরে রাখতে অসাধ্য সাধন করে মানুষটা। ভিনদেশী, ভিনজাত, ভিনধর্মেরমিলিকে আপন করে নিতে তার এতটুকু বাঁধেনি। তিন বছরের ছোট্ট জয়ীতাকে কোলে নিয়ে, ইন্টার পাশকরা শিক্ষাগত যোগ্যতাকে পুঁজি করে, সে যখন নানা-জায়গায় একটি কাজের আশায় ঘুরছিল, তখনইরিচার্ডের সাথে তার দেখা। সদ্য স্বাধীন হওয়া, যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশকে সাহায্য করার মিশন নিয়ে‘রিচার্ড জন রবার্টস’ এসেছিল বাংলাদেশে। মাত্র কয়েক মাসের পরিচয় থেকে প্রনয় এবং পরিনয়। গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ মিলির জীবন। এই গল্প কোন লেখকের কষ্ট-কল্পনার ফসল নয়। নিরেট সত্যি।
মিলি এবং ছোট্ট জয়ীতার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল রিচার্ড। তাদের উড়িয়ে নিয়েএসেছিল খোদ আমেরিকায়। সেই থেকে প্রবাসের এই দীর্ঘ জীবনে কখনও তাকে পেছনে ফিরে তাকাতেহয়নি। ফেলে আসা জীবনের জন্য কোন পরিতাপ করতে হয়নি।
তাদের ছেলে জিমি রবার্টস পেয়েছে শেতাঙ্গ বাবার মতই ধবধবে সাদা রং। ছয় ফুট উচ্চতা, নীল চোখ, সোনালি চুলের ছেলেটি অবিকল বাবার প্রতিচ্ছবি। নিজের পেটে জন্মানো এই ছেলেকে নিয়ে পথে বেরহলে লোকজন প্রায়ই তাকে বেবি-সিটার বলে ভুল করতো।
রেডি হতে হতেই মিলি রিচার্ডকে টেক্সট করলো। ‘হাই বেবী, আই’ম গোয়িং টু অ্যাটেন্ড অ্যা ‘ফ্রিডম ডে’ পার্টি ইন জ্যাকসন হাইটস। সি ইউ অন ডিনার টাইম।লাভ ইউ!’
সাজগোজ শেষে, ঘুরে-ফিরে অনেকক্ষণ নিজেকে আয়নায় দেখে, মিলির মন ভালো হয়ে গেলো। এইমধ্য-ষাটেও তাকে দেখে বয়সের প্রকৃত সংখ্যাটা অনুমান করা কঠিন। নিয়মিত জীম, সাথে সুষম আহারতার চেহারার লাবন্য শরীরের তারুন্য এখনও ইর্ষনীয়ভাবেই অটুট রেখেছে।
জয়ীতাকে তার কন্যা নয় বরং সহদোরা ভেবেই লোকজন বিভ্রান্ত হয়। মা-মেয়ের বয়সের তফাৎতোতেমন বেশী নয়। মাত্র সতেরো বছর। সদ্য পন্চাশ ছোঁয়া আত্মজাটি তার মায়ের লাবন্য, বাবার আদলপেয়েছে। তাদের পরিবারে একই সাথে বিজয় দিবস এবং জয়ীতার জন্মদিন পালিত হয়।
ইতোমধ্যে ‘ডে লাইট সেভিংস’ এর জন্য ঘড়ির কাটা এক ঘন্টা এগিয়ে আনা হয়েছে। ক্যালেন্ডারেরহিসেবে বসন্ত’ও এসে গেছে। যদিও বাইরে এখনও হিমেল হাওয়া বইছে। এই উইন্ডি ওয়েদারে হাল্কা কোনশাল নেবে কি নেবে না—তাই নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধায় ভুগলো মিলি। তারপর কি মনে করে, দেশের জাতীয়পতাকাটি দুভাঁজ করে শালের মত কাঁধের একধারে পরে নিলো সে।
(২)
ইদানিং মিলির অবসর যাপনের প্রধান অনুসঙ্গ হল লেখালেখি। লেখালেখির সুবাদেই নিউ ইয়র্কেরএকঝাঁক বাঙালি কবি-লেখকের সাথে মিলির খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। প্রতি জুনে জ্যাকসন হাইটস্ এরপিএস ৬৯ স্কুলে তিনদিনব্যাপী বাংলা বইমেলা হয়। মুক্তধারা প্রকাশনীর বিশ্বজিৎ সাহা এই মেলারআয়োজন করেন। বাংলাদেশের প্রচুর প্রকাশক বইয়ের সম্ভার নিয়ে এই মেলায় আসেন। তাই সারা বছরধরে নিউ ইয়র্কের প্রবাসি বাঙালিরা বইমেলার অপেক্ষায় থাকে। মিলি নিজেও এই বইমেলার অবিচ্ছেদ্য এক-অংশ। ইতোমধ্যে তার লেখা অনেকগুলে উপন্যাস, গল্প-সংকলন বাংলা একাডেমি বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলো সহ অন্যান্য স্থানীয় পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, অনলাইন ওয়েবজিনে নিয়মিত ছাপা হয় তার লেখা। ফেইসবুক পেইজে তার আছেবিশ হাজারের উপরে ফলোয়ার। নিজের টাইমলাইনে মিলির নিত্যদিনের স্মৃতিচারণ সারা বিশ্বের কারেন্টইস্যু নিয়ে লেখালেখিতে শ’খানেকের উপর লাইক পড়ে। তার অনুরাগীদের নানা মতামত, উৎসাহ এবংভালোবাসায় সিক্ত হন মিলি।
নিউ ইয়র্কের বাঙালি প্রধান এলাকাগুলোতে প্রচুর দেশীয় উৎসব হয়। উৎসব উপলক্ষ্যে সবার সাথেদেখাসাক্ষাৎ হয়। প্রচুর আনন্দ হয়। কিন্তু যেখানে বাঙালি আছে, সেখানে কোন্দলও আছে। চাঁদে কিংবা মঙ্গলে গেলেও তারা দলাদলি, কূটচাল ছাড়তে পারবে না। দেশীয় রাজনীতির নানা হঠকারিতা যখনদেশের ভাবমূর্তিকে মলিন করে দেয়, নতুন প্রজন্মের সামনে মিলির মত সচেতন মানুষরা খুবই লজ্জায়পড়ে যায়।
গতবছর আচমকা মহামারির কারনে নিউইয়র্ক বইমেলা ভেস্তে গিয়েছিল। এ-বছর হবে কি-না তাইনিয়েও সংশয়। গত-বইমেলা উপলক্ষ্যে ঢাকা গিয়ে মিলিকে লকডাউনে পড়তে হয়েছিল। নিউ ইয়র্কতখন করোনার রেডজোন। মিলি প্রতিদিন সিএনএন, সিবিএসের ভয়াবহ সব খবর শুনে দিশাহারা।গভর্নর কুমো, মেয়র ব্লাজিও, শীর্ষ চিকিৎসক ফাউসি প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য দিচ্ছেন। নতুন নতুনসতর্কতা জারি করছেন। ছেলেমেয়ে এবং রিচার্ড নিউ ইয়র্কে। ঘরে খাবার বারন্ত। বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয়জিনিস সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। সেইসব ভয়াবহ দিনের স্মৃতি মনে এলে মিলি এখনও শিউরে ওঠে।
করোনা নাকি আদৌ শেষ হবে না। সংক্রমণ লেগেই থাকবে। ভাইরাসের নতুন নতুন মিউটেন্ট আসতেইথাকবে। এ-এক নতুন পৃথিবী। কিন্তু জীবন যে বহমান। থেমে থাকার উপায় নেই। তাই একটু-একটু করেসচলতা বাড়ছে। প্রথম আলোর আজকের অনুষ্ঠানও তারই এক-প্রচেষ্টা। আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীমচৌধুরী বিশেষ করে যেতে বলেছেন। অনেকের মত মিলিও আজ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত স্মৃতি শেয়ার করবেন। সেজানের আত্মত্যাগের কথা বলতে গিয়ে অজান্তেই তার চোখঅশ্রুসজল হবে। কণ্ঠ বাস্পরুদ্ধ হবে। তবুও সেজান এবং তারেকের নাম উচ্চারণ করা তার দায়িত্ব।
করোনা পরিস্থিতির কারনে পুরো অনুষ্ঠানটির আয়োজন আউটডোরে করা হয়েছে। প্রথম আলো থেকের্যালী করে সবাই ডাইভার্সিটি প্লাজায় গিয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের পতাকা হাতে, সমবেত জাতীয়সংঙ্গীত পরিবেশনের পর শুরু হবে স্মৃতিচারনমূলক অনুষ্ঠান।
প্রতিবছর মার্চ এলে, ডিসেম্বর এলে, সেজানের কথা খুব বেশী মনে পড়ে মিলির। কত-কথা তাকে বলাহয়নি। তাদের প্রথম সন্তান—জয়ীতার খবরটিও তাকে দেওয়া হয় নি। তারেক-কেও খুব মনে পড়েমিলির। ভুলতে চাইলেও সবকিছু ভোলা যায় না। প্রিয় মানুষদের হারানোর এই হাহাকারটুকু—সে প্রাণপনে আড়াল করে। অতি-যত্নে বাক্সবন্দী করে রাখে। বিশেষ বিশেষ দিনে এই প্যানডোরা-বক্সের ডালা খোলা হয়। সেদিন থরেথরে সাজানো, যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা, মহামূল্যবান স্মৃতিগলো সে উল্টে-পাল্টে দেখে।
জয়ীতা তার জন্মের আগে থেকেই এ-সবকিছু জানে। নয় মাস মায়ের পেটের অন্ধকারে বসে সে শুনেছে তার বাবার কথা, যুদ্ধের কথা, বিজয়ের কথা। এসব গল্প শুনে-শুনেই মেয়েটি বড় হয়েছে। সে জানেবীরে-রা কখনও মরে না। তারা মৃত্যুন্জয়ী!
(৩)
তখন মুক্তিযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। এখানে-সেখানে চলছে চোরাগোপ্তা হামলা। সেজান যুদ্ধে যাবারপায়তারা করছিল। তাকে থামাবার কৌশল হিসেবেই সেজানের বাবা-মা একদিন মিলিদের বাড়িতেএলেন। মিলিকে আংটি পরিয়ে দিলেন। তার দিন-সাতেক পরই কাজী ডেকে, তড়িঘড়ি বিয়ে হয়ে গেল সেজান -মিলির। চারিদিকে ভয় আর আতঙ্ক। এরমাঝে বিয়ে। কোনরকমে দু’ই পরিবারের কিছুআত্মীয়-স্বজন একত্র হল মিলিদের বাড়িতে। ঘরোয়াভাবে পোলাও-কোর্মা রান্নার আয়োজন হল।সেজানের মায়ের বিয়ের লাল বেনারশি আর দু’পক্ষের মিলিত কিছু গহনাপত্র পরিয়ে বউ সাজানো হলমিলিকে। দিনের আলো ফুরিয়ে আসার আগেই খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে নতুন বউ নিয়ে তারা বাড়িফিরে এলেন।
পাড়া-প্রতিবেশী হিসেবে এবং পারিবারিকভাবে এই দুই পরিবারে দীর্ঘকালের সুসম্পর্ক ছিল। গ্রামেরঅবস্থাপন্ন মানুষ আশরাফ মির্জার একমাত্র সন্তান সেজান মির্জা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেধাবীছাত্র। ভাল ছেলে বলে গ্রামে তার সুনাম ছিল। সুদর্শন সেজান মির্জার একরাশ ঘণ চুল, অপূর্ব কণ্ঠস্বরেমুগ্ধ হয়ে মনে মনে প্রেমে পড়েছিল মিলি। কিন্তু স্বপ্ন-জগতের মানুষটি যে বাস্তবে ধরা দিতে পারে, তাস্বপ্নেও ভাবে নি। অথচ দুম করে তার সাথেই বিয়ে হয়ে গেলো। বিবাহিত জীবনের নতুন আবেশে, মুগ্ধতায়, প্রবল ভালোবাসায় তাদের মধুচন্দ্রিমার দিনগুলো দ্রুত কাটতে লাগলো।
প্রতিরাতে লুকিয়ে, আওয়াজ কমিয়ে রেডিও শুনতো সেজান। মিলিরও জয়বাংলার অনুষ্ঠান শোনার নেশা ধরে গেলো। চরমপত্র এবং জল্লাদের দরবারে মুক্তিযোদ্ধাদের চান্চল্যকর সব খবর শুনেশরীরের রক্ত চন্চল হয়ে উঠতো তাদের। রক্তে বেজে উঠতো যুদ্ধের দামামা। একদিন সেজানের বন্ধুতারেক এসে হাজির হল তাদের বাড়িতে। সে সেজানের বিয়ের খবর শুনে যারপর নাই তাজ্জব হয়ে গেল।
‘এই অসময়ে বিয়ে? আর ইউ ক্রেজি?’
‘বিয়ে না করে উপায় ছিল না, দোস্ত। বাবা-মায়ের মুখের উপর না বলার শক্তি আমার নেই। তাছাড়া, মিলি খুব চমৎকার মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই ওকে চিনি। শুধু বয়সটা একটু কম—এই যা!’
সেজান মিলিকে তারেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। মিলির হাতের চা, ডালপুরী খেয়ে এবং এসএসসিপরীক্ষার্থী মিলির আউটবুক পড়ার আগ্রহ দেখে তারেক মুগ্ধ হল। এরপর থেকে তারেক প্রায়ই আসতেশুরু করলো। সাথে থাকতো মিলির জন্য ভাল ভাল গল্পের বই। তারেকের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা লোমহর্ষক, চোরাগোপ্তা হামলার গল্প শুনে সেজানের যুদ্ধে যাবার বাসনা আবারও পুন্জিভূত হল।
‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।‘ বয়সটাই ছিল এমন। দেশের জন্য কিছু করার একটি উদগ্র নেশা তাদের রক্তে। তারেক বারবার এসে সেই নেশাটা খুঁচিয়ে চাঙ্গা করে তুললো। স্বার্থপরের মতশুধু নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকা যৌবনের ধর্ম নয়। সেজান যুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। মিলিকে একটু বোঝাতেই সেও রাজী হয়ে গেল। মিলির কল্পনায় মুক্তিযোদ্ধা সেজান তখন বন্দুক হাতে ছুটেচলেছে বন-বাদার পেরিয়ে। তার বন্দুকের নল থেকে ঝলসে উঠছে ধোঁয়া। পাকসেনাদের বুক বুলেটেঝাঁঝরা করে, গাড়ি পুড়িয়ে, নৌকা ডুবিয়ে, তারা গর্জে উঠছে জয়বাংলা শ্লোগানে। দেশ স্বাধীন হলেমাথায় লাল-সবুজ পতাকার পাগড়ী বেঁধে সেজান বাড়ি ফিরবে। তাকে মালা দিয়ে বরণ করা হবে। সেমিলিকে কোলে তুলে নিয়ে নেচে বেড়াবে বাড়ির উঠোনে। এসব অলীক কল্পনায়, গর্বে, আনন্দে, মিলিরচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
এক রাতে, চুপিচুপি সেজান চলে গেল তারেকের সাথে। যাবার আগে সে মিলিকে বললো, ‘আমিমাঝেমধ্যে এসে তোমায় দেখে যাব। মা-বাবার প্রতি খেয়াল রেখো।জানি বাবা খুব রাগ করবে, মা অনেককাঁদবে। কিন্তু দেশের এই দুর্দিনে এভাবে হাতগুটিয়ে বসে থাকা বড় অন্যায়। দেশ আমায় ডাকছে মিলি, আমায় যে যেতেই হবে।’
(৪)
সত্তরের শুরুর দিকে, বরিশালের আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে মার্কসবাদী বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে একটি দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দলের নাম পূর্ববাংলা সর্বহারা দল। তখনও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। সিরাজ সিকদার এবং হুমায়ুন কবীরের সাথে মার্কসবাদী তারেকের পরিচয় হয়েছিল বরিশাল বিএম কলেজে। ছাত্রদের এক আড্ডায়। এরা দু’জনও মার্কসবাদী। ওদের সাথে তারেকের মত ও পথের মিল হতে সময় লাগেনি। সিরাজ সিকদার পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে সচেতন ছিলেন।তাই সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন একটি দেশের স্বপ্ন দেখতেন। যুক্তিসঙ্গতভাবেই মুক্তি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল সর্বহারা দল। তারেকের হাত ধরে সেজানও যোগ দিল সর্বহারা পার্টিতে।
হুমায়ুন কবির, তার ছোটভাই ফিরোজ কবির, ছোট বোন আলমতাজ বেগম ছবি ছিলেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা দলের সক্রিয় সদস্য। দলে তাদের প্রভাবও অপরিসীম। হাতের লেখা ভালো ছিল বলে দলেরহয়ে পোস্টার লিখতেন কিশোরি ছবি। ফিরোজের বন্ধু সেলিম শাহনেওয়াজও দলের সক্রিয় সদস্য। শাহনেওয়াজ এবং ছবি তখন পরস্পরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। রণাঙ্গনের গুলির শব্দ, বারুদের ধোঁয়ারমাঝেই একদিন তারা বিয়ে করে ফেললো। ছবিকে দেখলেই সেজানের মিলির কথা মনে পড়ত।
মাঝেমধ্যে, গভীর রাতে, সেজান চুপিচুপি বাড়ি আসে। মিলি সন্তর্পনে দরজা খুলে দেয়। রান্নাঘর থেকেখাবার গরম করে, নিজ হাতে খাইয়ে দেয় ক্ষুধার্ত স্বামীকে। বুভুক্ষুর মত ঘরের খাবার খেয়ে, বুভুক্ষুরমতই মিলিকে ভালোবাসতো সেজান। প্রচন্ড উন্মাদনায় যখন রাত শেষ হয়ে যেতো, ভোরের আলোফোটার আগেই সে ফিরে যেতো ক্যাম্পে।
সেজানের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ছবি’র গল্প শুনে শুনে মিলি যেন কল্পনায় ছবিকে দেখতে পেতো। দেখতোছেলেদের পোশাক পরা, সেই দূরন্ত, দূধর্ষ কিশোরীর মাথায় বাঁধা লাল গামছাটি বাতাসে উড়ছে। সে লড়ছে গেরিলা যুদ্ধে। তার গ্রেনেডে পাকিস্তানিদের গানবোট ডুবে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নদীর পানি লাল হয়েউঠছে পাকিস্তানি এবং বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের রক্তে। পাশাপাশি, কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে তারপ্রেমিক শাহনেওয়াজ।
একসময় ফিরোজ এবং সিরাজ সিকদারের মতবিরোধ চরমে উঠলে ফিরোজ দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন। হুমায়ুন ও শাহনেওয়াজ এই বহিষ্কারের বিরুদ্ধাচারণ করলে দলের ভেতরের পরিস্থিতি আরও গুরুতররূপ নিল। ফলে শাহনেওয়াজ সস্ত্রীক পালিয়ে গেলেন। সিরাজ সিকদার শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষনা করলে, তারা খুলনার তুতপাড়ায় গা ঢাকা দেন। অন্যদিকে সিরাজ সিকদারেরহাত থেকে বাঁচলেও ফিরোজ পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে যায়। বরিশাল ব্যাপ্টিস্ট মিশনের খাল-পাড়েফিরোজের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরীন ঘটনা এবং একনায়কতন্ত্রের গল্প মিলিজেনেছিল সেজানের কাছে। কিন্তু দলের পরবর্তী কাহিনী শোনার সুযোগ মিলির আর হয় নি।
(৫)
এদিকে প্রায় মাসখানেক হয়ে গেল সেজানের কোন খোঁজ নেই। সেজান বা তারেক কেউ এসে তাদেরখোঁজ-খবর যানাচ্ছে না। নির্ঘুম রাত, নিদারুন হতাশা, নানা দুশ্চিন্তায় প্রায়ই শরীর খারাপ হতে লাগলমিলির। শেষ কবে একটানা ঘুমিয়েছে, তাও সে ভুলে গেছে।
এক সকালে, ঘুম থেকে উঠেই, পেটের ভেতরের সবটুকুই উগরে দিল সে পুকুর পাড়ের জঙ্গলা জমিতে।পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের মত গুঁটিশুঁটি মেরে পুকুরে নামলেও সেই অতল পানির দিকে তাকিয়ে মিলির ভয়ভয় লাগলো। হঠাৎ করেই তার মনে হল, সম্ভবত সে মা হতে চলেছে। এদিকে তার স্বামী নিঁখোজ।শ্বশুড়-শাশুড়ি ছেলের শোকে শয্যাশায়ী। পুরো পাড়া, গ্রাম শুনশান। পুরো দেশটা লন্ডভন্ড।
এমনি-এক নির্ঘুম রাতে, অবসন্ন শরীরে মিলি মরার মত পড়ে আছে। বাড়ির উঠোনে অপরিচিত মানুষেরপদশব্দে, তাদের ফিসফাস আওয়াজে মিলির শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলে। এরা কারা? কী চায়? কাকেখুঁজছে?
সকাল হতেই চাউর হয়ে গেল মির্জাবাড়ির সেজান মির্জার খোঁজে এসেছিল সর্বহারা পার্টির ছেলেরা।সেজান মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে নিঁখোজ হয়েছে কিংবা সিরাজ সিকদারের ভয়ে কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে।অনেকেই শান্তনা দিতে এসে নানা খোঁজ-খবর শুরু করলো। সেজানের বাবা বুঝতে পারলেন, এখানেথাকা আর নিরাপদ নয়। এখন পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা আসছে। এরপর আসবে রাজাকারআর মিলিটারি।
একরাতে শাশুড়ি তাকে চুপিচুপি ডেকে তুললো। ঘোরের মাঝে নিজেকে সে আবিস্কার করলো একটি বড়ছইতোলা নৌকায়। শ্বশুড়-শাশুড়ির হাতে তড়িঘড়ি গুছিয়ে নেয়া দু’টো ব্যাগ। ধরতে গেলে প্রায়শুন্যহাতে, চোরের মত চুপিসারে, তারা নৌকায় উঠে বসল। মাঝি যতটা সম্ভব নিঃশব্দ নৌকা ছাড়লো।তবুও খালের পানিতে কাঠের বৈঠার ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ রাত্রির নিরবতা ভেঙ্গে দিতে লাগলো। সেইতরঙ্গায়িত শব্দমালা মিলির বুকের ভেতর আছড়ে পড়তে লাগলো।
‘মা, যদি সে আসে, তাইলে আমাদেরতো খুঁজে পাবে না’, মিলির স্বর অস্ফুট কান্নায় ভেঙ্গে গেল। তারশাশুড়ি চোখ মুছতে-মুছতে বললো, ‘কত্ত হাউস কইরা বিয়া করাইলাম। কিন্তু মোর পোলাডারেতো তুমিধইরা রাখতে পারলা না বউ!’
তাইতো; মিলিতো কোন চেষ্টাই করেনি সেজানকে ঘরে আটকানোর। এই ব্যর্থতা, এই মহাসত্য যে এমনকাল হয়ে উঠবে, তা কে জানতো। তারা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের কথা ভেবেছে। কিন্তু এর রক্তাক্ত দিকটাতোতখনও চোখে পড়েনি। মনক্ষুন্ন মিলি তার পেটের উপর পরম স্নেহে হাত রাখল। বিরবির করে কৈফিয়তেরভঙ্গিতে বললো, ‘তুমি কষ্ট পাইও না মণি, তোমার বাবা নিশ্চয়ই আসবে। যুদ্ধ জয় কইরা আসবে।’
ততক্ষণে নৌকা খাল ছেড়ে বড় গাঙ্গে পড়েছে। বড় বড় ঠেঁউয়ের তোড়ে নৌকার দুলিনিও বেড়েছে। নদীরউথাল-পাথাল ঠেঁউ দেখে আতঙ্কিত হলেও সাহস হারালো না মিলি। পেটে হাত বুলিয়ে বললো, ‘তুমিভয় পাইও না সোনা। তোমার মা খুব ভাল সাঁতার জানে।’
তাদের নৌকার খুব কাছাকাছি যাচ্ছিল আরেকটি নৌকা। মাঝি উচ্চস্বরে হাঁক ছাড়ল , ‘নাও কম্মে যায়?’
‘মোরা যেদিক মনে লয় যাই।আমনেরে হ্যা কইতে অইবে?’
‘এইডা কোন কতা অইলে? এই গন্ডগোলের মইধ্যে হগ্গলেরই চোখকান সজাগ রাহা লাহে।’
‘তয়, আফনেরা কোম্মে যান?’
‘মোরা যাই জালকাডি। ঠেহায় না পড়লে এই রাইত-বিরাইতে কেডায় গাঙ্গে নাও বায়, কও?’
‘হ।হেইডাতো বলদেও বোজে। এহনতো হগ্গলেরই জেবন লইয়া টানাহেছড়া।’
‘পাইক্কাগুলানরে কোন বিশ্বাস নাই। কোনহানে যে ঐ ঝোলাগুলা ওঁত পাইত্তা রইছে।কওন যায় না।
‘হ বাইডি। নৌকায় বাল-বাচ্চা, বুড়া আছে। হেরপান্নে ডরে ডরে নাও বাই।’
‘এই পাইক্কাগো ডরে গাঁওগ্রামে কোন জনমানস্যি থাকবে বইল্লা মনে লয় না। বেবাকেই বর্ডার পার অইতেলাগছে।’
দুই মাঝির কথোপকথনের মাঝেই নৌকার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন কৃশকায় বৃদ্ধ। বৃদ্ধবললেন, “বাবা, এই বিপদে কই যামু কও? হগ্গলেই হুনছি বর্ডার পার অইতাছে। মোগো কপালে যে কি অইবে, ভগবানই জানে। নিজের দ্যাশ, ভিডা-মাডি ছাইড়া কার যাইতে মন চায়, কও দিহি?’
‘মুরব্বি, হাচাই কইছেন।হেই-যে ঝোলার যুদ্ধ শুরু অইলে। মোগো কপালও পোঁড়লে। যান দাদো, যেদিকপারেন জান লইয়া পলাই যান।’
বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাসটুকু দ্রুতই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নৌকা দুটোর মাঝেও দূরত্ব বাড়তে লাগলো। অন্ধকারেহাঙ্গরের মত হা করা বিষখালির বুকে কাগজের নৌকার মত দুলতে দুলতে দু’টো নৌকা দু’দিকে বাঁক নিল।তারপর একসময় তারা বিন্দুর মত মিলিয়ে গেল।
(৭)
একদিকে মিলিটারি অন্যদিকে সিরাজ সিকদারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেজান আর তারেক। নিজের এবং পেটের সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে মিলিকেও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামে। মিলির সময়কাটছে পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে। সারাক্ষণ সে পাগলের মত বিরবির করে কথা বলে। তার অনাগতসন্তানের কাছে সে বলে যায় তার বাবার কথা। যুদ্ধের কথা। বিজয় এলে তারা কত আনন্দ করবে সেইসব আশার কথা।
অবশেষে একদিন বিজয় এলো। আশরাফ মির্জা জীবিত বা মৃত সেজানের খোঁজখবর করার বহু চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেজান কিংবা তারেকের কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না। মিলিরা শুনেছে সিরাজসিকদার দলের বিদ্রোহীদের কখনওই ক্ষমা করেন না। জয়ীতার জন্ম হল নতুন স্বাধীন দেশে।স্বাধীনতা পরবর্তী দেশটিতে এলো বড় রকমের পরিবর্তন। সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধস্ত দেশ। চারিদিকেপ্রচন্ড অভাব, মহামারির মত দূর্ভিক্ষ্য। চরম অরাজকতা।
ভঙ্গুর দেশটিকে পুর্নগঠনের জন্য যোগ্য, নিঃস্বার্থ লোকের অভাবও দিনে দিনে প্রকটতর হয়ে উঠল।জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশাসনিক অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি, একনায়কতন্ত্র বাকশাল এবং রক্ষিবাহিনী গঠন নিয়ে গণ অসন্তোষ বেশীদিন চাপা রইল না। আড়ালে-আবডালে এইসব নিয়ে লোকজনের ফিসফিস একসময় প্রকাশ্য হয়ে উঠলো।
মিলিদের সংসারেও বড় রকমের পরিবর্তন এলো। শাশুড়ি একমাত্র সন্তান হারানোর এত বড় শোকসামলাতে পারলেন না। বাড়িতে নতুন মানুষ এলো তার শুন্যস্থান পূরন করতে। মিলির নিজের বাবারবাড়িতেও এলো পরিবর্তন। ভাইরা একে একে বিয়ে করলো। পেটের ভ্রুণকে দেয়া মিলির সব প্রতিশ্রুতিইভেঙ্গে পড়ল। ভয়ঙ্কর এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হল তাকে।
এমনি একসময়ে, একেবারে যেন দেবদূতের মত, বাংলার মাটিতে এসে হাজির হয়েছিল এক কান্তিমানপুরুষ। সমস্ত অনিশ্চয়তা, অনাদর থেকে বাঁচিয়ে মিলি আর তার আত্মজাকে হাতের তালুতে তুলেনিয়েছিলেন তিনি। তারপর পাখির মত উড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন এই ‘সব পেয়েছি’র দেশে।
প্রতি ডিসেম্বরে ‘মিলি সুলতানা রবার্টস’ নামের এই মার্কিন-বাঙালি নারী, মার্কিনমূলুকে বসে, সগৌরবে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারন করেন। মানুষের কাছে এইসব গল্প বলতে, বিজয়ের কথা বলতে তার খুব আনন্দ হয়। কেমন করে এক হবু তরুনী মাতা তার পেটের অনাগত সন্তানের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে যেতেন, অনাগত কন্যাকে কীভাবে তার পিতার বীরত্বগাঁথা শোনাতেন, পলিমাটি দেশের মেয়েটি যক্ষের ধনের মত একাত্তরকে এভাবেই তার হৃদয়ে আমরণ বাঁচিয়ে রাখতে চায়!
অলংকরণঃ তাইফ আদনান