আলোর দিশা
সারাক্ষণ জানলার দিকে তাকিয়ে কি এত ভাবিস! পড়াশুনায় মন দে বুবাই। ক্লাস টেস্টে যা করেছিস করেছিস মেইন রেজাল্ট খারাপ হলে বাবা কিন্তু এবার আস্ত রাখবে না।
পড়তে ভালো লাগে না আমার। পড়াশুনা করে কি হবে মা?
মানে! কি বলতে চাস তুই? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!
তুমি বুঝবে না।
তোকে পেটে ধরেছি আমি। আমি বুঝব না তো কে বুঝবে?
মা তুমি চুপ করো প্লিজ। আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু অন্যদের সাথে তো কথার বিরাম নেই। রাতে দরজা বন্ধ করে মোবাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা তুই কথা বলিস। কার ফোন জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিস না। মোবাইল নিয়ে নাড়া ঘাটা করিস। আমায় দেখলেই সাইট বন্ধ করে দিস। কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝিনা! পড়াশুনায় মন দে বুবাই, এ ভাবে দিন যাবে না।
বললাম তো পড়তে আমার ভালো লাগে না। পড়াশুনা করে বাবার মতো ইঞ্জিনিয়ার হয়তো হবো কিন্তু পাওয়ার পাবো না। পাওয়ার চাই পাওয়ার…..বুঝলে মা। পাওয়ার থাকলেই ঠাই ঠাই ঢিসুম ঢিসুম। তুমি শাহেনশা, সব তোমার হাতের মুঠোয়।
উত্তেজিত স্বরে কথাগুলো বলে বুবাই জানলার দিকে চোখ ফেরায়। কথা বাড়ায় না স্নিগ্ধা, একরাশ উদ্বেগ নিয়ে ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কদিন ধরেই বুবাই অন্য ভাবনায় ডুবে থাকছে সেটা স্নিগ্ধার নজরে পড়েছে, কিন্তু এরকম আচরণ আশা করে নি। উদ্ভট এই ভাবনা বুবাইয়ের মনে জাগলো কেন ভাবতে থাকে স্নিগ্ধা। ক্লাস টুয়েলভে পড়া ছেলের মাথায় কে ঢোকালো এসব! ওর সহপাঠীদের কারোর ইন্ধন নাকি অন্যকিছু। সুকল্যাণকে এখনই ব্যাপারটা জানানো কি ঠিক হবে! অস্থির হয়ে ওঠে স্নিগ্ধা। সন্তানের মুখ চেয়ে চাকরি ছাড়তে দুবার ভাবেনি। নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সর্বক্ষণ ছেলের ভালো চেয়েছে অথচ তার কপালেই ….।
আমি একটু বেরোচ্ছি। বুবাইয়ের কথায় স্নিগ্ধার চিন্তায় ছেদ ঘটলো।
এই অবেলায় কোথায় যাচ্ছিস?
উত্তর দেয় না বুবাই। ওর দৃষ্টি মোবাইলের স্ক্রীনে। বারান্দার কোলাপসিবল গেটটা টেনে হনহন করে বেরিয়ে যায়।
বুবাই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল অনেক দেরীতে। মাঝখানের কয়েকটা ঘন্টা উদ্বেগ আর মানসিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছে স্নিগ্ধা। যতবার ছেলেকে ফোন করেছে বুবাইয়ের ফোন হয় নট রিচেবল নয়তো নট অ্যান্সারেবল। অফিসে সুকল্যাণ প্রোজেক্ট মিটিং নিয়ে ব্যস্ত। ব্যাপারটা সুকল্যাণকে জানাবে ঠিক তখনই স্নিগ্ধার মোবাইল বেজে ওঠে। অচেনা নম্বর।
কি করছিস?
স্নিগ্ধার চোখে মুখে বিষ্ময়ের ছাপ। গলাটা খুব চেনা তবুও কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না।
কি হলো স্নিগ্ধা চুপ করে আছিস কেন? আমি সাহানা, এটা আমার অন্য একটা নাম্বার, সেভ করে রাখ।
সরি সাহানা বুঝতে পারিনি রে। তুই বাড়িতে না স্কুলে?
আজ ছুটি নিয়েছি, বাড়িতেই আছি। অনেক দিন কথা হয় না। তাই ভাবলাম নতুন সিম টা থেকেই তোকে কল করি।
সাহানা কিছু মনে করিস না প্লিজ। আমি একটু আপসেট আছি।
স্বাতী সাহানা স্নিগ্ধা এই তিনের জুড়ি ক্লাস থেকে কলেজ কম্পাউন্ড মাতিয়ে রাখত সর্বক্ষণ। হৈ হৈ করে সিনেমা দেখতে যাওয়া পার্লারে পাশাপাশি সিটে একসাথে রূপচর্চা, রেস্তোরায় পছন্দের খাবার ভাগ করে খাওয়া সবেতেই তিনজন। বিয়ের পরেও বাচ্চাদের নিয়ে চেনা ছকের গন্ডী পেরিয়ে পাহাড় জঙ্গল সাগর ঘুরে বেড়িয়েছে। একে অপরের আপদে বিপদে সাধ্যমতো পাশে থেকেছে। সাহানা ফোন করায় যেন বাড়তি শক্তি পেল স্নিগ্ধা। কোনরকম লুকোছাপা না করেই বুবাইয়ের ব্যাপারটা জানায়।
চিন্তার ব্যাপার! তুই আগে কোন হিন্ট পাস নি?
কদিন ধরেই দেখছি ওর অ্যাটিচুড একটু অন্যরকম। সবসময় বিরক্তি ভাব। পাঁচটা প্রশ্ন করলে দুটোর উত্তর দেয়। একদিন দুম করে দু হাজার টাকা চাইলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এত টাকা দিয়ে কি করবি? কি ভাবে যে মুখ ঝামটালো ভাবতে পারবি না।
সুকল্যাণদা জানে, ওকে বলেছিস?
সিঙ্গাপুরের একটা প্রোজেক্ট নিয়ে অফিসে সুকল্যাণ খুব চাপে আছে সাহানা। তবে এবার ওকে সবটা জানাতেই হবে।
আজকেই জানাবি, দেরী করবি না। আচ্ছা বুবাইয়ের গার্ল ফ্রেন্ড কেউ আছে বা হয়েছে কিনা জানিস?
জানি না। আগে সবকিছু বলতো। ইদানিং দেখছি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। সবকথায় হেঁয়ালি।
রিলেটিভদের কাছ থেকে কোনরকম ফিডব্যাক পেয়েছিস? ওর কাজিন ব্রাদাররা কিছু জানে? তোর জা ননদ ওদের সাথে কথা বলে দেখ না যদি কিছু ….
পাগল হয়েছিস, সবাই মজা লুটবে।
ঠিক আছে। তোরা বুবাইয়ের সাথে খোলাখুলি কথা বল তার পর আমাকে জানা। দরকার হলে ওকে কাউন্সেলিং করাতে হবে।
কতক্ষণ হয়ে গেল এখনো ফিরলো না। ভাল্লাগছে না, কিচ্ছু ভালো লাগছে নারে সাহানা। মনটা বড্ড আনচান করছে।
খুব স্বাভাবিক। আমার মনে হয় কোন বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছে বুঝলি। কতক্ষণ আর বাইরে থাকবে। পেটে টান পড়লে ঠিক চলে আসবে।
তবুও, চিন্তা হয় না বল।
চিন্তা তো হবেই তবে দুশ্চিন্তা করিস না। আমার দিদা মাকে বলতেন –সংসারে চিন্তা থাকবে তবে দুশ্চিন্তা নৈব নৈব চ। তাতে ফল ভালো হয় না। আমি রাখছি এখন, সাবধানে থাকিস। বুবাইকে বকাঝকা করিস না কিন্তু। বয়স টা ভালো না, মাথা ঠান্ডা রাখবি। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।
সুকল্যাণ এবং স্নিগ্ধা চৌধুরীর একমাত্র সন্তান রাজদীপ অর্থাৎ বুবাই ওর বাবার মতো ইঞ্জিনিয়ার হয় নি। সমাজ বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র এবং গবেষণার কাজে যুক্ত। দেশের প্রথম সারির পত্র-পত্রিকায় সমাদৃত হয়েছে রাজদীপ চৌধুরীর লেখা আর্টিকেল। যদিও সন্তানের কৃতিত্ব এবং সাফল্য সবটা দেখে যেতে পারেনি স্নিগ্ধা। দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে রাজদীপের তখন ফাইন্যাল ইয়ার। সেরিব্রাল অ্যাটাক হলো স্নিগ্ধার। সন্তানকে সঠিক দিশা দেখাতে পারলেও জীবন যুদ্ধে হেরে গেল।
রাজদীপের আশাতীত পরিবর্তন এবং সাফল্য খুব সহজ ছিল না। দিনের পর দিন ছেলের জন্যে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল স্নিগ্ধা। সঙ্গে পেয়েছিল প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু সাহানাকে। বাকীটা জানতে ইচ্ছে করছে খুব তাই তো? এবার তাহলে যাওয়া যাক সেন্টার ফর সোস্যাল সায়েন্সের মিনি অডিটোরিয়ামে যেখানে আমন্ত্রিত অতিথিরা নির্ধারিত সময়ের আগেই উপস্থিত হয়েছেন। রাজদীপের গবেষণা ধর্মী একটি গ্রন্থ সেখানে প্রকাশিত হবে। সম্মানীয় বিশিষ্টজনেরা মঞ্চের সামনে বসে আছেন। রাজদীপ চৌধুরী মঞ্চে উঠে নত মস্তকে সমবেত সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডে দাঁড়ায় –আজ আমার অত্যন্ত আনন্দের দিন, খুশির দিন। আবার মন খারাপের দিনও বটে। আমার মা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বাবা খুবই অসুস্থ তাই আসতে পারেন নি। তবে আমার জীবনে মা এবং বাবার পরেই রয়েছেন শ্রদ্ধেয়া দু জন। একজন মায়ের বন্ধু আমার আন্টি শিক্ষিকা সাহানা গুহ রায় এবং আমার জীবনের মোড় যিনি ঘুরিয়ে দিয়েছেন আমার আরেক আন্টি সাইকোলজিস্ট ডক্টর প্রণতি বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকের অনুষ্ঠানে স্বনামধন্যা মনোবিদ ডঃ প্রণতি বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু পেশাগত বাধ্য-বাধকতার কারণে তিনি আসতে পারছেন না। তবে আমি অত্যন্ত খুশি যে আমার অগ্রজপ্রতিম সাথী তথা গাইড, অধ্যাপক ডঃ সত্রাজিৎ দাশগুপ্ত আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন। আমি সাহানা আন্টি এবং স্যার সত্রাজিৎ দাশগুপ্ত দুজনকেই মঞ্চে উঠে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করছি।
ডঃ সত্রাজিৎ দাশগুপ্তর সাথে মঞ্চে উঠতে সাহানা গুহ রায় মৃদু আপত্তি করলেও বুবাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে উঠতে বাধ্য হলেন। পুষ্পস্তবক দিয়ে দুজনকেই অভ্যর্থনা জানানো হলো। তার পর মাইক রাজদীপের হাতে। কৈশোর ও তারুণ্যের সংকট এই বিষয়ের ওপর আমার লেখা “আলোর দিশা” গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছি মা স্নিগ্ধা চৌধুরীকে। গ্রন্থ স্বত্ত আমার পিতৃদেব মাননীয় সুকল্যাণ চৌধুরীর। আমার বিনীত প্রার্থনা সাহানা আন্টি আমার গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করুন এবং ডঃ সত্রাজিৎ দাশগুপ্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে বইটি প্রকাশ করুন।
অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সবাই করতালি দিয়ে রাজদীপ চৌধুরীর ইচ্ছাকে মর্যাদা দিলেন। আমন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমের ভিডিও ক্যামেরা জুম হয়ে মঞ্চের দিকে স্থির। স্টিল ছবির ক্যামেরার ঝলকও থেমে নেই। গ্রন্থ প্রকাশ পর্ব সাঙ্গ হলে মাইক্রোফোন আবারও রাজদীপের হাতে – বাইরের কাউন্টারে আমার বই পাওয়া যাবে সংগ্রহ মূল্যের বিনিময়ে। আমার বিশ্বাস আপনারা বইটি নেবেন, পড়বেন এবং অবশ্যই মতামত জানাবেন। সংবাদ মাধ্যমের বন্ধুদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত থেকে যেতে অনুরোধ করছি। আমার আজকের প্রকাশিত গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করে কিভাবে আমি বেড়ে উঠেছি। পাশাপাশি আছে নতুন প্রজন্মের সামাজিক সংকটের চিত্র। ভুল রাস্তায় হেঁটে কিভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে কত উজ্জ্বল মেধা এবং স্বপ্ন। আপনারা পড়লেই বিস্তারিত ভাবে জানতে পারবেন। প্রথমে আমি সাহানা আন্টিকে অনুরোধ করছি কিছু বলার জন্য। তার পর বলবেন আজকের সম্মানীয় অতিথি আমার গাইড সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষক ডক্টর সত্রাজিৎ দাশগুপ্ত।
নমস্কার, আমার পরিচয় ইতিমধ্যেই আপনারা পেয়েছেন। আমার অতি প্রিয় বান্ধবী স্নিগ্ধার একমাত্র সন্তান রাজদীপ চৌধুরী, আমাদের বুবাই। কলকাতার খুব নামী স্কুলের ছাত্র। নামী স্কুলের ভালো যেমন আছে মন্দও আছে। ওখানে প্রায় সবক্ষেত্রেই কমপিটিশন। কিন্তু পড়াশুনার বাইরেও অন্য কমপিটিশন আছে যেটা খুব সুখকর নয়। সেখানে বিত্তশালী পরিবারের কতিপয় ছেলে মেয়ে সম্পদ এবং বৈভব প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। ওদের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে হীনমন্যতার শিকার হয়ে যায় সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা। উঁচু ক্লাসে উঠে ঠিক তেমনটাই হয়েছিল বুবাইয়ের। আমার বন্ধু স্নিগ্ধা খুব ভেঙে পরেছিল। সে অনেক কথা। তবে সমস্যাটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলাম মনোবিদ ডঃ প্রণতি ম্যামের সাথে। স্নিগ্ধা বেঁচে থাকলে ছেলের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতো। সেই কাজটা বুবাই আমাকে দিয়ে করালো। আমি ধন্য, আমি অভিভূত। সাহানা গুহ রায়ের গলা বুজে আসে। মাইক্রোফোন এগিয়ে দেন সত্রাজিৎ দাশগুপ্তর হাতে। গোটা অডিটোরিয়ামে নেমে এসেছে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
ক্ষনিকের নীরবতা ভঙ্গ করলেন ডঃ সত্রাজিৎ দাশগুপ্ত -অডিটরিয়ামে উপস্থিত সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। রাজদীপকে ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটা পরিবেশ উপহার দেবার জন্য। রাজদীপের গবেষণা ধর্মী গ্রন্থ “আলোর দিশা” আজ যেটা প্রকাশিত হলো সেটির বিষয় ভাবনার আভাস আপনারা পেয়েছেন। এক নিদারুণ সংকটের মুখে বর্তমান প্রজন্মের কৈশোর এবং তারুণ্য। প্রশ্ন উঠতে পারে এই সংকট কি হঠাৎ এসে হাজির হলো? আমার উত্তর –না, এটা হঠাৎ করে আসেনি। যুগের পরিবর্তনের সাথে এসেছে। চলমান সমাজের কাঁধে ভর করেই এই সংকট দ্রুতগামী হয়েছে। আমাদের সময় একটা শিশু বেড়ে উঠেছে পাঁচ জনের ঘেরা টোপে। দাদু ঠাকুমা দিদিমার কাছে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর গল্প এবং মজাদার ছড়া শুনে। সেখানে শিশু ভুল করলে শাসন ছিল, স্নেহের পরশ ছিল। মাথার চুল ঘেঁটে অথবা গাল টিপে আদর ছিল। আহ্লাদ আবদার ছিল। কয়েক দশক আগেও টেপ রেকর্ডারে লালকমল নীলকমল, নার্সারী রাইমস শুনতে শুনতে বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়েছে। আর এখন শিশুর হাতে মোবাইল, খেতে মোবাইল ঘুমতে মোবাইল। অনেক ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র মা বাবার ঘেরা টোপে শিশু বড় হচ্ছে। দাদু দিদা ঠাকুমার স্নেহের পরশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ শিশু মনকে বিকশিত করে। পরিবারের অন্যদের সঙ্গ পাওয়া শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরী।
কথা প্রসঙ্গে আমি কিছু অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আমার অতি পরিচিত এক নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির একমাত্র ছেলে নামী স্কুলে বারো ক্লাসে পড়ছে। মাসে তার পাঁচ হাজার টাকা হাত খরচ চাই। কারণ জিজ্ঞাসা করলে কোন উত্তর নেই! এই নিয়ে মায়ের সাথে নিত্যদিন অশান্তি। ছেলেটির মা ভদ্রমহিলা আমায় খুব করে ধরলেন। চা পানের অছিলায় গিয়ে হাজির হলাম ওদের বাড়ি। গল্পের ছলে ছেলেটির সাথে মজ়ে গেলাম। পাঁচ হাজার হাত খরচের কি কারণ জানতে চাইলাম। কোনরকম রাখঢাক না করেই বললো -আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। তুমিই বলো আঙ্কেল ওকে নিয়ে কি আমি ফুটপাথের ভাঙা বেঞ্চে বসে চাউমিন খেতে পারি? পার্ক স্ট্রীটের কাফে ডি মিউজ়ে যাব। পাশাপাশি বসে গল্প করবো, সী ফুড খাবো। ইচ্ছে হলে মিউজিকের সাথে ডান্স করবো। ঠিক কিনা বলো আঙ্কেল?
আমি বললাম- তোমার গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে কোথায় যাবে, কি খাবে সেটা তোমার ব্যাপার। তার দায় তোমার মা বাবার হবে কেন?
ছেলেটির উত্তর শুনে চমকে উঠেছিলাম। ও বলেছিল –অফকোর্স মা-বাবার দায়। জন্ম যখন দিয়েছে দায় তো তাঁদের নিতেই হবে আঙ্কেল।
উঁচু ক্লাসে পড়া এরকম বেশ কিছু ছেলে মেয়ের বিভিন্ন সমস্যার কথা আমার জানা আছে যা মোটেই ভালো নয়। শৈশব থেকে কৈশোর এবং তরুণ প্রজন্মের বেড়ে ওঠার এরকম বিভিন্ন সমস্যার ছবি ওর বইয়ে তুলে ধরেই থেমে থাকেনি রাজদীপ। উদ্ভূত সেই সমস্যা দূরীকরণের সম্ভাব্য উপায়ও তুলে ধরেছে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ছাড়াও মূল্যবান অনেক বিষয় প্রতিভাত হয়েছে ওর গ্রন্থে। কাজটা খুব সহজ ছিল না। প্রসঙ্গত আমি একটি ছেলের বিষয়ে উল্লেখ করেছি কিন্তু তার মানে এই নয় যে মেয়েদের বেড়ে ওঠার কোন সমস্যা নেই। মেয়েদেরও অনেক সমস্যা এবং যন্ত্রণা। খুব ছোট ছোট বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া অথবা অবলীলাক্রমে সমাধান হতে পারা বিষয়কে অকারণে জটিল করে তোলার মানসিকতা। রাজদীপের লেখায় সেসব আছে। ছেলে অথবা মেয়ে উভয়ক্ষেত্রেই আমার খুব খারাপ লাগে যখন দেখি ওদের অনেকের ভালো বন্ধু নেই। এমন কেউ নেই যার কাছে মনের দরজা হাট করে খুলে দেবে।
আমি আমার কথা শেষ করছি এই অনুরোধ জানিয়ে যে রাজদীপের অদ্যকার প্রকাশিত বইটি আপনারা সংগ্রহ করবেন এবং পড়বেন। উপস্থিত সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেছা ও ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। শুভ রাত্রি।
অনুষ্ঠান শেষে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব সাঙ্গ করে গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন সত্রাজিৎ দাশগুপ্ত। মধ্য চল্লিশের এক ভদ্রমহিলা কাছে এসে দাঁড়ালেন। চোখে মুখে উদ্বেগের ছাপ। সত্রাজিৎ দাশগুপ্ত নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন।
-কিছু বলবেন
-হ্যাঁ, আমার ছেলেকে নিয়ে খুব সমস্যা
-কি রকম
-সব সময় একা থাকে। আমাদের সাথে কথা বলতে চায় না। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না। সেদিন হঠাৎ রেগে উঠে বললো –আমায় বিরক্ত করবে না। আমি বেঁচে থাকার মানে খুঁজছি।
-বয়স কতো?
-এপ্রিলে সতের কমপ্লিট হলো।
-একজন সাইকোলোজিস্টের সাথে যোগাযোগ করুন। দেরী করবেন না।
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন