জলধি / গল্প / অলোক আচার্যের তিনটি অণুগল্প
Share:
অলোক আচার্যের তিনটি অণুগল্প
বনলতার চেয়ে সুন্দর

আমার বিশ্বাস ছিল বনলতা নামের সব মেয়েরাই সুন্দর হয়। বনলতা সেনের চোখ, ঠোট, গায়ের রং যদি কারও সাথে মিলে যায় তাহলে আর কিসের বনলতা সেন! জীবনানন্দ দাসের বনলতা কবিতা পড়ার পর থেকেই এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে। আমার ধারণা কবিতা পড়ার পর বনলতা সেনের প্রেমে পড়েনি এমন যুবক কমই আছে। বনলতা সেনের মোহ কাটানো সহজ কথা না! কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পাশে বসা সুশ্রী তরুণীটির সাথে জীবনানন্দেও কবিতার বনলতার কোনো মিল নেই। ঢাকায় যাওয়ার সময় বাসের সিট পরেছে পাশাপাশি। কি সৌভাগ্য আমার! দুজনেই চাকরির পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা। হোক ভিন্ন। উদ্দেশ্য তো একই। চাকরি। তার নাম বনলতা শোনার পর জিজ্ঞ্যেস করেছিলাম, নাটোরের বনলতা সেন? মেয়েটি হাসতে হাসতে বললো, ভালোবাসেন বুঝি? আমি লজ্জায় পরে যাই। সত্যি বলতে গিয়েও ঠোঁটের ডগায় এসে আটকে যায়। তারপর মেয়েটি হাসতে হাসতেই বলে, আমি জীবনানন্দের বনলতা নই। আমি বনলতা তালুকদার। চলবে? তারপর বলতে থাকে, জানেন, আমার নাম বনলতা হওয়ায় বেশ বিরক্ত থাকি। সবাই প্রথমেই আমার সাথে কবিতার বনলতাকে মিলিয়ে দেখে। কি আশ্চর্য! আমি একটা জ্যান্ত মানুষ। কবিতা নই। অথচ আমার তুলনা হয় কবিতার বনলতার সাথে। বলেই মেয়েটি মাথা নিচু করে। আমি বেশ খারাপ লাগে। বিশ্রি একটা ব্যাপার ঘটে গেলো। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিই। তার দিকে তাকিয়ে বলি, আরে না আপনি বনলতা সেনের চেয়ে কম সুন্দর না। তাছাড়া কবিতার বনলাতে তো কেউ দ্যাখেইনি। আপনাকে দেখছি। বলার সময় লক্ষ্য করি, মেয়েটি সত্যি সত্যি বনলতা সেনের চেয়ে সুন্দর।


অপেক্ষা

কিছুক্ষণ আগেও স্টেশনটা ফাঁকা ছিল। দুয়েকটা কুকুর এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। প্রথমে তাড়াহুড়ো করে এক দম্পতি এলো। এদিক ওদিক তাকালো। সেখানে আরও কেউ আছে কি না সেটাই যাচাই করে নিলো। তারপর বেশ শান্ত ভঙ্গিতে একটি বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। ট্রেন আসার অপেক্ষা। তার কিছু সময় পর দুই তরুণ এলো। বন্ধু। তারা কোনো একটি বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুব হাসাহাসি করছে। স্টেশনের এক কোণে এক পাগলীটা অকারণেই হাসছে। অ্যাই বাদাম, অ্যাই বাদাম চিৎকার করতে করতে এক বাদামওয়ালা স্টেশনে এসে ঢুকলো। স্টেশনে বেশি মানুষ না দেখে মনে হয় লোকটি হতাশ হয়। তার বাদাম, বাদাম বলার গতি কিছুটা কমে যায়। অবশ্য তার বিশ্বাস ট্রেন আসলেই তার বাদাম বিক্রি বেড়ে যাবে। সে ট্রেন আসার অপেক্ষায় থাকে। এর মধ্যেই আরও কিছু মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। কেউ কেউ মোবাইলে সময় দেখছে। এক তরুণীকে বলতে শোনা গেলো, ইশ ট্রেনগুলো যে কেন সময় মতো আসে না! তার কথায় বিরক্তিভাব স্পষ্ট। স্টেশনে উপস্থিত সকলেই ট্রেনে যাওয়ার জন্য আসেনি। কয়েকজন উৎসুক দর্শনার্থী এসেছে ট্রেন দেখতে। অবশেষে ট্রেন আসে। অপেক্ষারত সকলেই যেন একসাথে দম ছাড়ে!


ডাক্তার

মেয়েটি আমার দিকে আরেকটু ঝুঁকে এলো। এখন মেয়েটির শরীরের গন্ধ আমার নাকে মুখে লাগছে। দারুণ একটা পারফিউম মেখেছে মেয়েটা। আহা! এত কাছ থেকে তার গন্ধ পাচ্ছি। মেয়েটি বললো, আপনার কোন দাঁতে সমস্যা? আমি হাঁ করে দেখিয়ে দিলাম। এসেছি দাঁতের ডাক্তারের কাছে। নাম শুনে বুঝতে পারিনি যে এই ডাক্তারের সাথেই আমার একসময় বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছিল। কোনো এক দৈব দুর্বিপাকে সেই বিয়েটা ভেঙে যায়। অবশ্য নাকচ করা হয় আমার পরিবার থেকেই। আমার মতামতের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। ফলে আমি জোর দিতে পারিনি। মেয়েটা আমাকে ফোন দিয়ে কারণ জানতে চেয়েছিল। আমি কারণ পরিবারের সিদ্ধান্তের কথা বলেছিলাম। মেয়েটি বলেছিল, আপনার কোনো মতামত নেই? আমি নিশ্চুপ। হাঁ করে ছিলাম প্রশ্ন শুনে। আজও হাঁ করেই আছি। তবে দাঁত ব্যাথায়! সেই মেয়েটাই এখন পুরোদস্তুর দন্ত চিকিৎসক। আর আমার মাড়ির দুটা দাঁতের যাচ্ছেতাই অবস্থা। গত কয়েকমাস ধরেই ভাবছিলাম একটা দাঁতের ডাক্তার দেখাবো। কিন্তু সময় হচ্ছিল তো পকেট ফাঁকা আবার পকেটে টাকা থাকলেও সময় হচ্ছিল না। এই দুই যখন মিলে গেলো তখন খোঁজ নিয়ে জানলাম নতুন একজন মহিলা ডাক্তার এসেছে আমাদের হাসপাতালে। কাজের হাত খুব ভালো। আর খুব যতœ সহকারে রোগী দেখেন। আমার স্ত্রী ঠেলেঠুলে আমাকে এক বিকেলে দাঁতের ডাক্তারের কাছে পাঠালো। চেম্বারে ঢুকে নাম দেখে বুঝতে পারিনি। যখন তার মুখোমুখি হলাম তখন সেও বুঝি আমাকে চিনতে পারলো না। কিন্তু আমি ঠিক চিনেছি। আমার পোকা খাওয়া দাঁতগুলো নিয়ে যখন সে ব্যস্ত তখন আমি ব্যস্ত আমার অতীতে ফিরে যেতে। বিয়েটা হলে ক্ষতি কি হতো! একটা ডাক্তার পেতাম ফ্রিতে! যাওয়ার সময় টাকা দেওয়ার সময় সে বললো, কেমন আছেন? আমি বললাম, ভালো। আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন? সে মৃদু হাসলো।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান