১
প্রায় তিন মাস হয়ে গেল হাওলাদার হাউজিং কনস্ট্রাকশানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তৌফিক হাওলাদারের অর্গাজম হচ্ছে না। ওয়েট বা ড্রাই কোনটাই না। সাথে আছে ইরেকটাইল ডিসফাংশান।
বয়স পঁয়তাল্লিশ পার হয়েছে গতমাসে; তিনি বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক।
প্রথমবার ব্যাপারটা ঘটলো স্ত্রীর সাথে। প্রায় পনেরো বছরের দাম্পত্য জীবনে এর আগেও এরকম হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। তবে এবারের ব্যাপারটা যে সেরকম নয় সেটা প্রথম দুই সপ্তাহ যাবার পর টের পেলেন তৌফিক হাওলাদার।
শুরুতে ভেবেছিলেন পেশাগত চাপের কারণে তৈরি হওয়া স্ট্রেস থেকে ঘটছে ব্যাপারটা। বেশ কয়েকটা প্রজেক্ট অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে-কোনটার কাজ অর্ধেক বাকি, কোনটার দুই-তৃতীয়াংশ, আবার কোনটার কাজ একদম শেষের দিকে এসেও নানা কারণে আটকে আছে। দুইজন ক্লায়েন্ট ইতোমধ্যে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন; বেশ কয়েকজন ফোন করে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। যারা এখনো চুপচাপ আছেন, তারাও হয়তো এদেরকে দেখে উৎসাহিত হয়ে যা করার করবেন।
প্রথম সপ্তাহে ব্যাপারটা নিয়ে বিব্রত থাকলেও বিচলিত হননি তৌফিক হাওলাদার। এত অল্পতে বিচলিত হলে তার চলে না। তিনি জানেন ব্যবসার মতো দাম্পত্যেও ব্যর্থতা আসে। আর এই ব্যাপারটা তো দাম্পত্যের একটা দিক মাত্র; বাকি দিকগুলো তো ঠিকঠাক আছে বা তিনি বিশ্বাস করেন তিনি ঠিকঠাক রেখেছেন। এখনই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাবড়ে গেলে চলবে না বরং সমাধানের পসিবল স্ট্র্যাটেজিগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। ঠিক যেমনভাবে তিনি তার ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জগুলোকে ডিল করেন।
সমস্যাটা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিবার সেক্সের সময় তৌফিক হাওলাদারের মনে হয়েছে একটা সিরিঞ্জের মাথায় ইনজেকশনের তরলটুকু অভেদ্য, অনতিক্রম্য একটা পর্দার ওপাশে যেন গোঁয়ারের মতো আটকে রেখেছে নিজেকে।
দ্বিতীয় সপ্তাহে অসমাপ্ত সেক্সের পর ট্রাউজারের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বেডরুমের অ্যাক্রেলিক ইমালশান দেওয়া দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি স্ত্রী সায়মাকে বললেন-
‘কী যে হলো বুঝলাম না, বুঝলা! অফিসে ক্লায়েন্টদের নিয়ে কিছু ঝামেলা যাইতেসে…ঐ কারণে মনে হয়। আই অ্যাম সরি।’
স্ত্রীকে কোন প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে হাল্কা কেশে গলাটা পরিষ্কার করে তিনি বললেন-
‘সামনের মাসে চলো সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসি। তুমি দেখো কয়েকদিনের ছুটি নিতে পারো কিনা। উই নিড এ ব্রেক।’
তৌফিক হাওলাদারের স্ত্রী সায়মা হাওলাদার একটা বহুজাতিক কোম্পানির হেড অ্যাকাউন্টেন্ট। ছেলে সিয়ামের বয়স এগারো আর মেয়ে জারার বয়স সাত। সন্তানদের সবকিছু মোটামুটি সায়মা-ই সামলান। বাবা হিসেবে তিনি শুধু মাঝে মাঝে খোঁজ নেন যে ওদের কারো কিছু লাগবে কি-না।
সায়মা এই প্রস্তাবের উত্তরে কিছু না বলে বিছানায় উল্টো ঘুরে শুতে শুতে শুধু বললেন-
‘দ্যাটস ওকে। গিভ ইট সাম টাইম।‘
তৌফিক হাওলাদার আর কথা বাড়ালেন না। ডিম লাইট আর এসিটা অফ করে দিয়ে বনানীর এই অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে নিজের পাঁচতলা’র ফ্ল্যাটের বেডরুমের স্লাইডিং জানালাটা খুলে দিলেন; ভেতরের ঘেমো অস্বস্তিটার সাথে সমঝোতা করার জন্য একটা বেনসন লাইট ধরালেন।
তৃতীয় সপ্তাহেও একই ঘটনা ঘটলে সায়মা বললেন-
‘তোমার বোধহয় স্ট্রেস যাচ্ছে অনেক। আমি ছুটি পাব না কিন্তু তুমি কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারো।’
চতুর্থ সপ্তাহেও ঘটনা অপরিবর্তিত থাকলে সায়মা কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরেই বললেন-
‘একজন স্পেশালিস্টের সাথে একবার কথা বলে দেখবা নাকি?’
বলা বাহুল্য ব্যাপারটার এ পর্যায়ে বেশ মুষড়ে পড়লেন তৌফিক হাওলাদার। পেশাগত স্ট্রেসের ব্যাখ্যাটার ওপর এখন আর নিজেই বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। কেননা এজাতীয় চাপ তার আগেও ছিল কিন্তু এগুলো কখনো তার সেক্স লাইফে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। একেবারে রুটিনবাঁধা জীবন যাপন না করলেও মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন তার। খাওয়া-দাওয়া বা ঘুমের রুটিন মাঝে মাঝে কিছুটা এদিক-সেদিক হয় বটে তবে রেগুলার এক্সারসাইজ আর সেক্স-এর ব্যাপারে তিনি বেশ নিয়মানুবর্তী।
গোল্ড জিমের অ্যানুয়াল মেম্বারশিপ নিয়েছেন প্রায় বছর তিনেক আগে এবং সপ্তাহে পাঁচদিন সেখানে নিয়মিত ব্যায়াম করেন। এদিকে নিজের সেক্স লাইফেও ভ্যারিয়েশন রেখেছেন তিনি। বিবাহিত জীবনের বাইরে একজন নিয়মিত ও আরও কয়েকজন অনিয়মিত সেক্স পার্টনার রয়েছে তার। সময়, ব্যস্ততা, পরিস্থিতি ও চাহিদা অনুযায়ী একেকবার একেকজনের কাছে যান। তিনি বিশ্বাস করেন যে সেক্স-লাইফে এই স্বাদ বদলাবার উপায়গুলো না থাকলে তার অসম্ভব স্ট্রেসফুল এই বিজনেসটি তিনি এতগুলো বছর ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারতেন না।
এসব সেক্স পার্টনারদের কাছ থেকে কখনো স্ফুরিত ঝর্ণার তৃপ্তি নিয়ে, আবার কখনোবা কিছুটা অতৃপ্তি নিয়ে প্রতিবার নিজের গণ্ডিতে ফেরেন তৌফিক হাওলাদার। মনোটনি এড়াতে স্ত্রীর সাথে সেক্সের সময় মুড ও প্লেজারের এক্সপেকটেশান অনুযায়ী মাঝে মাঝে অন্য নারীকে কল্পনা করেন। তবে এ ব্যাপারে অতৃপ্তিটা বেশি থাকলে বা বলা যায় খানিকটা তৃপ্তি না আসা পর্যন্ত তাকে তার সহজাত হিউমারাস মুডে দেখা যায় না।
সায়মার স্পেশালিস্ট কনসাল্ট করার প্রস্তাবে নার্ভাসভাবে হাসলেন তৌফিক হাওলাদার। কোন উত্তর না দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে হাই কোমোডে বসলেন। কোমোডের পাশেই একটা তেলাপোকা উল্টে পড়ে আছে; শুঁড় দু’টো ও খাঁজকাটা সরু পাগুলো নাড়াচাড়া করছে কিছুক্ষণ পর পর কিন্তু সোজা হতে পারছে না কিছুতেই। মানবশিশু হাঁটতে শেখার আগে এভাবেই শুয়ে থাকে। এটাই তার জন্ম-পরবর্তী বেশ কয়েক মাসের একমাত্র ফিজিক্যাল পজিশন। তেলাপোকাদের ব্যাপারটাও কি সেরকম নাকি?
তৌফিক সাহেব তার ডান পায়ের স্লিপারটা দিয়ে উল্টে থাকা তেলাপোকাটাকে পিষে ফেললেন। ‘টাশ’ করে একটা শব্দ হলো। বোবা প্রাণী, মৃত্যু-যন্ত্রণায়ও নিজে থেকে কোন শাব্দিক প্রতিক্রিয়া দিতে পারে না। সেই দায়িত্ব তার শরীরের একটা অঙ্গ ও প্রকৃতি ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছে। মুহূর্তেই থেঁতলে যাওয়া পোকাটার ছিন্নভিন্ন শরীরটা ভেজা টাইলসের সাথে লেপটে গিয়ে আলোর বিপরীতে কোমোডের পাশের দেওয়ালে একটা অস্বচ্ছ ছায়া তৈরি করেছে।
পোকামাকড় বা পশুপাখি নিয়ে তৌফিক হাওলাদারের কখনোই কোন আদিখ্যেতা ছিল না। আজও নেই। কিন্তু সদ্যমৃত তেলাপোকাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন একটা মিহি অস্বস্তিবোধ হলো তার। সেই সাথে একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে।
২
ইন্টারাপটেড সেক্স লাইফের একমাস পার হওয়ার আগেই তিনি কয়েকবার ভেবেছিলেন যে অন্য সেক্স পার্টনারদের কাছে যাবেন। কিন্তু তার আহত পৌরুষ তাকে সেটা করতে দেয়নি। ব্যাপারটা যেন অনেকটা একটা খেলার মাঠে হেরে গিয়ে মাঠ বদল করে অন্য মাঠে চলে যাবার মতো। এদিকে প্রথম মাঠে তাকে হারতে দেখে ফেলেছে গ্যালারিতে বসা সব অগণিত দর্শক। অগণিত দর্শক বলতে এখন পর্যন্ত শুধু তার স্ত্রী। কিন্তু তার স্ত্রী-ই যেন হাজারো দর্শকে খন্ডিত হয়ে সহস্র কণ্ঠের একজোট বিদ্রূপকে ধারণ করেছে যা সে সামনাসামনি প্রকাশ করতে পারেনি।
এরকম চলতে থাকলে ডাক্তারের কাছে তাকে একসময় না একসময় যেতেই হবে কিন্তু নিজের এই নতুন ব্যর্থতার সাথে বাহাসটা প্রথমে তিনি নিজেই করতে চান।
ব্যাপারটা এরকম নয় যে সায়মার প্রতি তিনি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছেন। বরং বলা যায় স্ত্রীর প্রতি এখনো দারুণ আকর্ষণ বোধ কাজ করে তার। মধ্য পঁয়ত্রিশ পেরোনো সায়মা একটু বডি ফিটিং পোশাক পরলে ওর অঙ্গসৌষ্ঠব ঝিকিয়ে ওঠে এখনো। বিশেষত: হাঁটার সময় সায়মার শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে যে ঢেউটা খেলে যায় সেটা ভোগ ও উপভোগের সময় তৌফিক হাওলাদার এখনও নিজের ভেতর ত্রিশ বছরের যুবকের চাঞ্চল্য ও পেশল কামনা অনুভব করেন।
তবে তার এই কামজ আনন্দ এক নতুন মাত্রা পায় যখন তিনি আবিষ্কার করেন অন্য কোন পুরুষ সায়মার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। একবার তার অফিসে ইন্টার্নি করা এক ছোকরা সায়মা অফিসে এলেই নানা অজুহাতে তৌফিক হাওলাদারের রুমের চারপাশে ঘুরঘুর করতো। উদ্দেশ্য সায়মাকে এক নজর দেখা। ছোকরা এসি’র মধ্যেও ঘামতে থাকতো আর সায়মার সাথে কথা বলার সময় ভীষণ নার্ভাস হয়ে যেতো। ব্যাপারটাতে দারুণ মজা পেতেন তিনি।
সেইসব রাতে সায়মার সাথে বিছানায় যাওয়ার পর তার মনে হতো ইন্টার্ন ছোকরাটা যে সায়মাকে নিয়ে লাগামহীন কল্পনা করে সেই সায়মা এখন তার কণ্ঠলগ্না। ব্যাপারটা অন্যের অলীক স্বপ্নকে নিজের লৌকিক মুঠির ভেতরে বন্দি করে ফেলার নিষ্ঠুর বিজয়ের মতো আনন্দের।
পঞ্চম সপ্তাহে নিজের পৌরুষের সাথে এক ধরনের সমঝোতা করেই তিনি গেলেন সিনথিয়ার কাছে, তার বিবাহ-বহির্ভূত নিয়মিত সেক্স পার্টনার।
বছর পঁচিশের হাল্কা-পাতলা গড়নের কোমল চেহারার সিনথিয়াকে দেখে অনেক পুরুষই আকৃষ্ট হবে। কেউ কেউ হয়তো সিনথিয়ার প্রতি তাদের কাম-কাতরতাকে একপাশে ঠেলে রেখে দেবীর আসনে বসাতে চাইবে ওকে; কল্পনায় অপত্য ও স্নিগ্ধ প্রেমের বুদ্বুদ তৈরি করে নানা ইউজলেস স্বপ্ন-টপ্নও দেখবে ওকে নিয়ে।
তৌফিক হাওলাদারের কাছে প্রেমট্রেম জাতীয় ব্যাপার শারীরিক আকর্ষণের একটা ন্যাকা ন্যাকা ভূমিকা ছাড়া আর কিছু না। পুরো খেলাটাই যে শরীরের-বয়স যতো বাড়ছে এই বোধটা তার মধ্যে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।
শুধু একবারই একটা প্রেম টাইপ ব্যাপার হয়েছিল তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়। অন্য ডিপার্টমেন্টের এক দিঘল-কেশী সুনয়নার জন্য ফিদা হয়েছিলেন তিনি। একমাস প্রচণ্ড অস্থিরতা ও নিদ্রাহীনতায় কাটানোর পর মেয়েটাকে প্রোপোজও করেছিলেন। উত্তরে মেয়েটা তাকে কিছু বলেনি, শুধু হেসেছিল। এরপর ক্যান্টিনে বা লাইব্রেরির সামনে যেখানেই দেখা হতো মেয়েটা একইভাবে হাসতো। একদিন তিনি শুনলেন তার ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়রের সাথে রুমডেটে গিয়েছে তার সম্ভাব্য প্রেমিকা। এরপর থেকে যখনই মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে হাসতো, তৌফিক হাওলাদারের সোলায়মান চাচার কথা মনে হতো। সোলায়মান চাচা গ্রামের বাড়িতে তাদের প্রতিবেশী ছিলেন। মায়ের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে তিনি ঠিক এই দিঘল-কেশীর মতোই হাসতেন। কলেজে পড়ার সময় স্ট্রোক করে যখন তার বাবা’র শরীরের নিম্নাংশ অবশ হয়ে গেল, সোলায়মান চাচার তখন তাদের বাড়িতে আসাটা আরও নিয়মিত হয়ে উঠলো। একদিন কলেজ থেকে অসময়ে ফিরে আসার পর কিশোর তৌফিক হাওলাদার রান্নাঘরের উনুনের আঁচে মায়ের ঘর্মাক্ত মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলেন সোলায়মান চাচাকে। চাচার মুখে ছিল সেই একই হাসি। তার স্কুল শিক্ষক বাবা’র সব সঞ্চয় মোটামুটি শূন্য করে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসার আগে বাবার জন্য খুব তীব্র ও অদ্ভুত একটা কষ্ট হয়েছিল তার।
সিনথিয়ার সাথে তার পরিচয় তার ডেন্টিস্ট বন্ধু চিন্ময়ের চেম্বারে। মফস্বলের একটা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সিনথিয়া ঢাকার একটা ডেন্টাল কলেজের শেষবর্ষের ছাত্রী। ও চিন্ময়ের চেম্বারে এসে বসে থাকতো রোগীদের দাঁতের নানা সমস্যার চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হাতে-কলমে শেখার জন্য।
মেয়েটার প্রতি তিনি প্রথম আকৃষ্ট হয়েছিলেন ওর চুল আর মুখের ছায়ার ভেতরে তিরতির করে কাঁপতে থাকা অধোবদন সমর্পণটুকু দেখে। ঘাড় পর্যন্ত বাদামি চুল আর সমর্পিত মুখটা নিয়ে হেঁটে চলার সময় একটা প্রচ্ছন্ন উদাসীনতা খেলে যেতো সিনথিয়ার পুরো অবয়বে। যেন চারপাশের পুরুষগুলোর চোখে নিজের সৌন্দর্যের প্রশংসার ব্যাপারে ও ঠিক সচেতন নয়। কিংবা হলেও সেটা ওর খুব গভীরেব বয়ে যাওয়া গোপন নদীর স্রোতের মতোই গোপন। বলা যায় তার চারপাশে জীবন যেভাবে ঘটছে তাকে সেভাবেই ঘটতে দিচ্ছে মেয়েটা।
ওর এই নির্বিকারত্ব বা আপাত: নির্বিকারত্বের মধ্যে কোথায় যেন একটা অসহায়ত্ব আছে। আর এই অসহায়ত্বটুকুকে দখল নেয়ার মধ্যে একটা তীব্র কামজ আনন্দ খুঁজে পেয়ে যান তৌফিক হাওলাদার।
সিনথিয়ার সাথেও কিছু ঘটলো না। তবে সিনথিয়া যেহেতু তার পেইড সেক্স পার্টনার তাই তাকে কৈফিয়ত দেওয়ার কিছু নেই তার; সিনথিয়ার দিক থেকেও বিরক্তি প্রকাশের কোন সুযোগ নেই।
তবে এটাও ঠিক যে সদ্য মধ্য-চল্লিশ পেরিয়ে তার সেক্স-এবিলিটি যে ফুরিয়ে যায়নি বরং ব্যাপারটা যে শুধুই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা সেটা সিনথিয়াকে না বোঝানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না তিনি। স্ত্রী সায়মাকে বলা কারণটাই তাই তিনি রিপিট করলেন তবে ‘সরি’ বলার পার্টটুকু বাদ দিয়ে-
‘ব্যবসার টেনশন বুঝলা। বাট দিস ইজ টেম্পোরারি অফকোর্স । তুমি আগামী বৃহস্পতিবার রেডি থাইকো। গ্র্যান্ড সুলতানে যাব।’
সিনথিয়া মনে হলো কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে। এরকম এর আগে কখনো হয়নি। ডেন্টাল কলেজে তার রেজাল্ট দুর্দান্ত না হলেও ভালোই করছে সব মিলিয়ে। হাওলাদার সাহেবের দেওয়া টাকা থেকেই তার পড়াশোনার খরচ ও ব্যক্তিগত খরচই শুধু নয়, মফস্বলের বাড়িতে মা-বাবা আর ছোট ভাইয়ের যে পরিবারটা আছে তাদের খরচের সিংহভাগ আসে। এমনিতেই বাবা’র ক্যাশিয়ারের চাকরিটা হঠাৎ চলে যাওয়ার পর ওর ডেন্টাল কলেজে পড়াটাই অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল। এখন যদি হাওলাদার সাহেব তার উপর অখুশি হয়ে ওঠেন, সিনথিয়ার মোটামুটি গুছিয়ে আনা জীবনটায় এই শেষ দিকে একটা বড় ঝামেলা লেগে যাবে।
সিনথিয়ার কাছ থেকে ফেরত আসার পর থেকে তৌফিক হাওলাদারের রাতের ঘুম ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করলো। একরাতে ছাড়া ছাড়া ঘুমের পর শেষরাতের দিকে একটা দুঃস্বপ্ন দেখলেন: দেখলেন যে তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে গুলশানের নাভানা টাওয়ারের সামনের একটা ফুটপাথ দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। পেছনে পেছনে টোকাই ধরনের কিছু ছেলেমেয়ে হাতে আইসক্রিমের কাঠি, সিগারেটের ছেঁড়া প্যাকেট ইত্যাদি হাতে নিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে তাকে পেছন থেকে ধাওয়া করছে। সামনের বড় রাস্তার সব গাড়ি থেমে আছে; গাড়ির ভেতর থেকে উৎসুক ও কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে নানা বয়সের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মেয়ে জারা’র বয়েসি একটা মেয়ে নিজের দুই বেণি দুইহাতে চেপে ধরে চালকের আসনে থাকা বাবাকে বলছে-
‘ড্যাডি, হোয়াই ইজ দ্যাট আঙ্কেল নেইকেড।’
ষষ্ঠ সপ্তাহে তিনি গেলেন তার অনিয়মিত সেক্স পার্টনারদের একজন মিতুর কাছে। মিতু একজন পূর্ণবয়স্কা হাউজওয়াইফ। মিতুর কাছে যাওয়ার দুই দিন আগে কিছু এক্স-রেটেড মুভি দেখার মাধ্যমে আরেক দফা নিষ্ফল চেষ্টা চালালেন তৌফিক হাওলাদার।
মিতুর হাসবেন্ড থাকে আমেরিকায়। তৌফিক হাওলাদার ছাড়াও মিতুর আরও কিছু ছেলে-বন্ধু আছে। মিতুর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা হলো সেক্সের ব্যাপারে ওর অনাড়ষ্ট ও ম্যাচিওর অ্যাপ্রোচ। সায়মা ও সিনথিয়া ফোরপ্লে’র যে ব্যাপারগুলো ঠিক আগ্রহ নিয়ে করে না, মিতু সেগুলো বেশ অ্যাকটিভ এঞ্জয়মেন্ট নিয়ে করে। এটা ভাবলেই মিতুর কাছে আসার আগে থেকেই তার মধ্যে আসন্ন যৌন-তৃপ্তির একটা আগাম বোধ উস্কে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মেয়েটার ভীষণ অ্যাপিলিং হাস্কি ভয়েস যেটা ফোরপ্লে’র পুরো সময়টাতে বাজতে থাকা ইন্সট্রুমেন্টাল জ্যাজের মধ্যে টুকরো টুকরো ইম্প্রোভাইজড লিরিকের মতো শোনায়।
বলা বাহুল্য যে মিতুর সাথেও কিছু হলো না তার। মিতুর অভিজ্ঞ চোখের নির্ভার তারায় তিনি স্পষ্ট বিদ্রূপ দেখলেন। অসমাপ্ত সেশনটার পর মিতু যখন উঠে যাচ্ছিলো, তৌফিক হাওলাদারের তখন নিজেকে রিলে রেসের ক্লান্ত ও বুড়িয়ে যাওয়া ক্রীড়াবিদ মনে হচ্ছিলো যার দৌড়ানোর মধ্যে আগের ক্ষিপ্রতাটুকু আর নেই।
এই বিদ্রূপ কি সায়মার চোখেও ছিল? ছিল সিনথিয়ার চোখেও? তার সাথে সম্পর্কের ডাইমেনশান অনুযায়ী ওরা হয়তো বিদ্রূপটুকু ঢেকে রেখেছিলো নানা কায়দায় ও আচরণে-ব্যাপারটা কি এরকম?
তৌফিক হাওলাদারের অফিসে দুই মাস আগে যে নতুন রিসিপশনিস্ট মেয়েটা জয়েন করেছে এতসব স্ট্রেসের মধ্যে ওকে নিয়ে তার ভাবনাটা ঠিক পরিণত হয়ে উঠতে পারেনি। মেয়েটার একটা বয়ফ্রেন্ড আছে যে হয়তো কাছেই কোন অফিসে কাজ করে। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর ছেলেটা বাইকে করে এসে প্রেমিকাকে নিয়ে যায়। তৌফিক হাওলাদার নিজের রুমের স্লাইডিং জানালার কাঁচ দিয়ে এই দৃশ্য দেখেন নিয়মিত।
মেয়েটার হাঁটা-চলা ও কথা বলার মধ্যে অদ্ভুত একটা আত্মবিশ্বাস আছে। তিনি এটুকু বোঝেন যে এই মেয়েকে বশে আনা খুব সহজ হবে না বা হয়তো একেবারেই সম্ভব হবে না। ব্যাপারটা সায়মাকে দেখে সেই ইন্টার্নি করা ছোকরাটার ছোঁকছোঁক করার বিপরীত কোণের একটা অনুভূতি। অর্থাৎ মেয়েটাকে কখনো তিনি শয্যায় পাবেন না এই উপলব্ধিটা তার মধ্যে একটা তীব্র ও বন্য আর্জ তৈরি করে-অন্যের অধিকার করা সম্পদের দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে একটা নিষিদ্ধ সুখ আহরণের গোপন উইন্ডো-শপিং এর আনন্দের মতো।
এভাবে মাস দুয়েক কেটে যাওয়ার পর নিজের নার্ভাসনেস আর নিজের কাছেই লুকাতে পারলেন না তৌফিক হাওলাদার ; এখন তার স্পষ্টতই মনে হচ্ছে যে নিজের কাছে আত্মসমর্পণের সময় এসে গেছে। এভাবে নিজের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত পালানোটা কোন সমাধান হতে পারে না। এ পর্যায়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
তার বন্ধু হাসিব স্কিন অ্যান্ড সেক্স স্পেশালিস্ট। তৌফিক হাওলাদারের বিবাহ-বহির্ভূত যৌন-জীবনের কথা সে জানে। টেস্টের রিপোর্ট দেখে হাসিব বলল-
‘টেস্ট তো তোর সবই নরমাল রে পাগলা! আমার কাছে তো ব্যাপারটা সাইকোলজিক্যাল মনে হচ্ছে।’
৩
তিন মাস পর। বাতাসে সদ্য শুরু হওয়া বর্ষা’র জলজ ঘ্রাণ। তৌফিক হাওলাদার বসে আছেন ঢাকার অদূরে অপেক্ষাকৃত ছিমছাম ধরনের উপশহর টাইপের একটা জায়গার একটা স্ন্যাক্সের দোকানে। এখানে ঢাকার বেকারি স্টাইলে কেক-পেস্ট্রি থেকে শুরু করে শিঙাড়া-সমুচা শর্মা-বার্গার আলুর চপ, মালাই চা-কফি-লাচ্ছি সবই পাওয়া যায়। দোকানের ম্যানেজার এই মুহূর্তে কিছুটা বিরক্ত, উদাসীন একটা চেহারা বানিয়ে কাউন্টারে বসে চা খাচ্ছেন আর নিজের দিকে ঘোরানো ছোট্ট টিভি স্ক্রিনটাতে একটা ঢালিউডি অ্যাকশন সিনেমা দেখছেন। কাউন্টারের কাছে গেলেই পুরনো স্পিকার থেকে ভোঁতা ঘস-ঘসে শব্দের ঢিঁসইঁয়াই ঢিঁসইঁয়াই মারামারির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
তৌফিক হাওলাদার এরই মধ্যে দুই কাপ কড়া মিষ্টি দেওয়া কন্ডেন্সড মিল্কের চা শেষ করে তিনটা সিগারেট পুড়িয়ে চার নাম্বারটা কেবল ধরিয়েছেন। তিনি এমনিতে চিনি ছাড়া চা খান ও ওকেশনালি স্মোক করেন কিন্তু আজকে এসব কিছুই মানছেন না। তার সামনে ওয়ানটাইম প্লাস্টিক প্লেটে রাখা আধ-খাওয়া কলিজার শিঙাড়াটা সামনের দিকে হাঁ হয়ে থাকা একটা বন্ধ বালু ঢালাই করার মেশিনের মতো পড়ে আছে।
আজকে তিনি কোন কিছুরই গন্ধ পাচ্ছেন না- না চা, না শিঙাড়া না সিগারেট-কোনকিছুরই না।
তার সামনের টেবিলে যে লোকটা বসে আছে সে বেশ অস্বস্তি-মেশা আনন্দ নিয়ে সদ্য ওভেনে গরম করে দিয়ে যাওয়া একটা শর্মা খাচ্ছে। লোকটার চোখেমুখে একজন মধ্যবিত্ত গৃহকর্তার ছাপ স্পষ্ট। সিনথিয়াকে নিয়ে তিনি আগে যখন এখানে এসেছিলেন তখনও লোকটাকে দেখেছিলেন দু’একবার। তবে এর আগে প্রতিবারই সে তার বউ-বাচ্চা সহ খেতে এসেছিল। একবার তিনি দেখলেন লোকটা একটা গরম আলুর চপ ভেঙে ভেঙে চুঁড়ো করে ঝুঁটি করা ছোট্ট মেয়েটার মুখে তুলে দিতে দিতে বলছে-
‘বেশি গরম আম্মা? আস্তে আস্তে খাও। আব্বা খাওয়ায়ে দিতেসি।’
এটা মোটামুটি পরিষ্কার যে লোকটা এভাবে একাকী রেস্টুরেন্টে খেতে আসতে অভ্যস্ত না। তাই আজকে খাওয়ার সময়ে তার চোখে-মুখে একটা প্রচ্ছন্ন অপরাধবোধ ফুটে উঠেছে। একটু পর পর মাথা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, যেন খেয়াল করছে হঠাৎ করে সে পরিচিত কারও চোখে পড়ে যায় কি-না।
তৌফিক হাওলাদার খেয়াল করে দেখেছেন যে মধ্যবিত্ত বাবারা একা একা এঞ্জয় করে কিছু খেতে পারে না। খাওয়ার সময় তারা বউয়ের কথা চিন্তা করার ভান করে আসলে চিন্তা করে নিজের ছেলে-মেয়েদের কথা। এরকম পরিস্থিতিতে তৌফিক হাওলাদারের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে কিন্তু আজ ফুটল না। বরং সেই জায়গায় তার নিজের দুই সন্তান সিয়াম আর জারা’র মুখ দু’টো তার মনে ভেসে উঠলো। তবে সেটা খুবই অল্প সময়ের জন্য।
তার দেখতে ইচ্ছা করছে লোকটা খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাসার জন্য পার্সেল নিয়ে যায় কি-না। তবে আজকে তিনি এখানে একটা কাজ নিয়ে এসেছেন যেটা দ্রুত সারতে হবে। এখন মনকে অন্য দিকে সরে যেতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। চতুর্থ সিগারেটটা দুই-তৃতীয়াংশ ফুঁকে অ্যাশট্রেতে গুঁজে যখন অন্যমনস্কভাবে উঠে পড়লেন তখন বাইরে দু-এক ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে।
হোটেল রয়াল ইন্টারন্যাশনালে নিজের ডিলাক্স রুমে যখন ফিরলেন তৌফিক হাওলাদার তখন বেশ ভরাস্বরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আজকে খুব ঘন ঘন বাথরুম পাচ্ছে তার। পনেরো মিনিটের মধ্যে তৃতীয়বার বাথরুমে যেতে যেতে হঠাৎ বিছানার বিপরীতে দেওয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। খুব ক্লান্ত আর রোগা দেখাচ্ছে তাকে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকেন তিনি। এভাবে কিছুক্ষণ স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকার পর তিনি আবিষ্কার করলেন যে আয়নাতে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কিংবা বলা যায় বর্তমানের তৌফিক হাওলাদারকে আর দেখা যাচ্ছে না। বরং সেখানে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে বহু বছর আগের প্রায় ভুলে যাওয়া একটা দৃশ্য-বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে টলোমলো হয়ে ওঠা তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটা দূরত্বের পুকুরটা।
তার বয়স যখন পাঁচ কি ছয় তখন মেলা থেকে বাবা তার জন্য প্লাস্টিকের যে বলটা কিনে এনেছিলেন সেটা দিয়ে একদিন দুপুরে একা একা খেলার সময় বলটা গড়াতে গড়াতে পুকুরে পড়ে যায়; এরপর স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতে চলে যায় মাঝ-পুকুরে। সাত বছরের তৌফিক হাওলাদার একটা খাটো বাঁশ দিয়ে বলটাকে পাড়ে আনার চেষ্টা করতে করতে গিয়ে পিছলে পুকুরে পড়ে যান; মুহূর্তেই ভেসে যান স্রোতের সাথে। বাবার নানা চেষ্টা সত্ত্বেও তখন পর্যন্ত সাঁতারটা শেখা হয়ে ওঠেনি তার।
আয়নায় দেখা যাচ্ছে নির্জন শুনশান এক বর্ষার দুপুরের পুকুরের মাঝখানে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে করতে ডুবে যাচ্ছেন বালক তৌফিক হাওলাদার।
এদিকে আকাশটা মেঘলা হতে হতে ঘন ধূসর রঙে বদলে যাচ্ছে আর দু-এক ফোঁটা করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। সেদিন তাকে শেষমেশ বাঁচিয়েছিলেন সোলায়মান চাচা। কিন্তু চাচাকে তো আয়নায় কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এটা কি এজন্য যে সোলায়মান মারা গেছেন প্রায় দশ বছর হতে চললো? তিনি শুধু দেখলেন পুরো আয়না জুড়ে তার বেঁচে পুকুর পাড়ে ফেরার তীব্র চিৎকারের আকুতি খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ছে।
ঘেমে উঠলেন পঁয়তাল্লিশ পেরোনো তৌফিক হাওলাদার। ঝট করে আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে বিছানার পাশে সোফার সামনে রাখা বোতলটার দিকে তাকালেন। এখন মন অন্যদিকে সরতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। ভয়ঙ্কর বিষ ভরা বোতলটা তাকে বেশ ঝামেলা করে জোগাড় করতে হয়েছে। এক ঢোকে আধা গ্লাস খেয়ে নিতে পারলেই নিশ্চিত মৃত্যু। ব্যথার অনুভূতি মগজে লতিয়ে ওঠার আগেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন আর সেই অবস্থাতেই তার মৃত্যু হবে। এভাবেই তৈরি করা হয়েছে এই মহার্ঘ বিষ।
বাইরে আকাশটা কমলা আর ধূসরের বিচিত্র মিশেলে বদলে যেতে যেতে বিকেলটা তার শেষ হাঁটুতে ঢুলছে। তৌফিক হাওলাদার ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন বোতলটার দিকে। আয়নাটা নীরব হয়ে গেছে এর মধ্যে। তিনি হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিলেন।
এই সময় হঠাৎ জানালার বাইরে একটা কোলাহল শোনা গেল। কিছু মানুষের মিলিত কলরব ও হৈ চৈ এর টুকরো মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। রুমের ভেতরে এসি চলছে কিন্তু তৌফিক হাওলাদার জানালার কাছে সরে এসে বেশ জোরাজুরি করে জানালাটা খুলে ফেললেন। বৃষ্টিটা মিইয়ে এসেছে এরই মধ্যে।
হোটেল রয়াল ইন্টারন্যাশনালের সামনেই উপশহরটার লোকাল ট্রেন স্টেশন। স্টেশনে ঢোকার কেঁচি গেটের মুখেই একটা চব্বিশ-পঁচিশ বছরের মেয়েকে ঘিরে একটা জটলা তৈরি হয়েছে। মেয়েটার পরনে জিন্সের প্যান্ট ও স্কিন-টাইট গেঞ্জি। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা মাঝবয়েসী একজন শক্তপোক্ত চেহারার মহিলা মেয়েটাকে পেছন থেকে টেনে ধরে রেখেছে আর সামনের দিকে বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন নারী-পুরুষ ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের সব শব্দ ভেদ করে মহিলাটার উচ্চকিত গলা শোনা গেল-
‘এইটা ভদ্রলোকের এলাকা। এইসব ফাতরা জামা-কাপড় পইরা এইখানে ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা হাটা যাইব না। মাগিবাজি ঢাকায় গিয়া কর খানকি…’
তৌফিক হাওলাদার মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেন। খাঁচায় আটকে পড়া শিকারের মতো প্রাণপণে খাঁচার দরজা খুঁজছে সে। ফিনফিনে বৃষ্টির ঈষৎ অস্পষ্টতার ভেতর মেয়েটার চেহারার দিকে তাকাতেই তার মনে হলো তিনি সায়মাকে দেখছেন; তরুণী বয়সের সায়মা। বিশেষ করে হাঁচড়-পাঁচড় করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করার সময় মেয়েটার ঊর্ধ্বাঙ্গের দেহ-বল্লরীর যে হিল্লোলটা দৃষ্টিগোচর হলো সেটা দেখে আরও নিশ্চিত হওয়া গেল ব্যাপারটা।
ইতোমধ্যে চারপাশে জড়ো হওয়া লোকজনের জটলা আরও ঘন হয়ে এসেছে। রিকশার ট্রিং ট্রিং বেল, কাজ থেকে বাড়ি ফেরা মানুষের ব্যাগ হাতে জটলার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে করা নানা ধরনের মন্তব্য, হাড়গিলে কুকুরগুলোর হঠাৎ কিছু ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে পড়ে লেজ নাড়া আর দ্রুত বদলাতে থাকা শেষ বিকেলের রং এর ভেতরে মেয়েটার চেহারাটা হঠাৎ অবিকল সিনথিয়ার চেহারায় বদলে গেল; আনত মুখের সিনথিয়ার সেই অসহায়ত্বটুকু যেন একটা বৈকালিক অয়েল পেইন্টিং হয়ে ফুটে উঠলো মেয়েটার পুরো মুখমণ্ডলে। মেয়েটা এ সময় চিৎকার করে উঠলো-
‘আমাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যান প্লিজ…প্লিজ…’
আরেব্বাহ! মেয়েটার গলার স্বর তো একদম মিতুর মতো! সেই হাস্কি অ্যাপিলিং স্বর। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মেয়েটা হঠাৎ নিজেকে কিছুটা ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হলেও পুরোপুরি ছাড়াতে পারলো না মহিলার শক্ত বেড় থেকে। আরে এখন তো আবার ওকে দেখতে তৌফিক হাওলাদারের অফিসের সেই রিসিপশনিস্ট মেয়েটার মতো লাগছে।
হচ্ছেটা কী!
মেয়েটা বোধহয় এবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে। দমে গেলেন তৌফিক হাওলাদার। এখন কি বাইকে করে ওর বয়ফ্রেন্ড এসে মেয়েটাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে ঠিক রিসিপশনিস্ট মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডের মতো? মেয়েটার আশেপাশে যদিও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নাকি ও একাই দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারবে?
বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটার চুল কপালে লেপ্টে গেছে। পরনের কুঁচকে ওঠা টি-শার্ট আর সমস্ত মুখমণ্ডলটা ছলকে ওঠা বৃষ্টিস্নাত তারল্যে আর আশপাশে জ্বলে উঠতে থাকা সান্ধ্য বাতির রঙে ধীরে ধীরে চকচকে ঘিয়ে রঙে পাল্টে যায়। ওর পুরো অবয়বে একটা অনাস্বাদিত বন্যতার প্রবল হাতছানি। আকাশে মেঘ গর্জন করে ওঠে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে।
তৌফিক হাওলাদারের যখন অর্গাজম হলো তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে; সোফার নিচ থেকে আয়েশি ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসা একটা তেলাপোকা তার পায়ের একদম পাশে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে তার শুঁড় দু’টো নাড়তে থাকে।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান