পারকিংলটের টিকেট কোথায় গেলো?আশ্চর্য তো। আনিস, তুমি নিয়েছে?
নো মা নো। বাট মা বাবা?
প্লেন কেবল ল্যান্ড করেছে।বাবার বের হতে সময় লাগবে।তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। বাবা বের হলেই দেখতে পাবে।
ছয় বছরের আনিস মায়ের মাথায় জাকেটের হুড টেনে দিয়ে বলে, প্রোমিজ?
হ্যাঁ, প্রোমিজ।এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে।আমি দেখি টিকেটটা কোথাও পড়ছে কিনা। এখনই চলে আসবো।ওকে?
আনিসকে স্থির হয়ে দাঁড়াতে বলে, মায়া জেএফকে বিমান বন্দরের অ্যারাইভাল টার্মিনাল ফ্লোরে এদিক সেদিক তন্ন তন্ন করে টিকেট খুঁজলো।মায়ার স্পষ্ট মনে পড়ে জ্যাকেটের পকেটে রেখেছিলো।কেন যে গাড়িতে না রেখে দিতে ভুলে গেলো।
ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, মায়া ছেলের কাছে ফিরে আসতেই পিছন থেকে কেউ একজন বলে, ম্যাম আর ইউ লুকিং ফর...,
মায়া ঘুরে মুখোমুখি হতে দুজনেই চমকে ওঠে!
মায়া?
চমকে যাওয়ার সমস্ত সময়টুকু কাটিয়ে উঠতে মায়া সময় নিলো না।ঠোঁটের কিনারে নোমান ডাক আসলেও ফিরিয়ে নেয় ।মায়া তাকায় নোমানের দিকে।একটু বেশি সোজা ভাবে তাকায়।নোমানের দৃষ্টিতে উষ্ণতা মাখা।
মায়া হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।
মায়া,
নোমান আবার ডাকতেই, মায়া বলে,আমার ছেলে একা দাঁড়িয়ে আছে। টিকেটটার জন্য ধন্যবাদ।
তোমার ছেলে? কোথায়?
মায়া কিছু বলার আগেই, আনিস দৌড়ে এসে মায়ের হাত টেনে বলে,মা কাম।
নোমানের হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেলো না নিজেই রাখলো, বোঝা গেলো না।মায়া আনিসকে কিছু বলার আগেই সে আবার ছুটে যেতে যেতে বলে মা কাম। বাবা আসবে।
মায়া পা বাড়াতেই, নোমান ওর হাত ধরে বলে একটু দাঁড়াও।
মায়ার হাত ছাড়াতে হলো না।নোমান নিজেই ছেড়ে দিলো। মায়ার মনে হলো এত বছর পর আবার যেন কোথা থেকে ভেসে আসা অপ্রীতিকর বাষ্প তাকে নিশ্বাস নিতে দিচ্ছে না।
অ্যারাইভাল টার্মিনাল – প্যাসেঞ্জার বের হয়ে আসছে। নোমানের হাতে সময় নেই কোন ভূমিকা করার। নোমান মায়ার সামনে এসে দাঁড়ায়।
মায়া, আমার ভুল হয়েছিলো, কিন্তু আমার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো। মায়া আমি ভুল করেছিলাম, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলের সময় তুমি ...
নোমান, তোমার ভুল ছিলো না।তোমার সিদ্ধান্ত ছিলো।তবুও যদি ভুল বলো তবে বলি সব ভুল ভাঙ্গানো যায় না।
মায়া চলে যেতে গিয়েও থেমে যায়। নোমানের ভেজা চোখে চোখ রেখে বলে, ও যদি দেখতে হুবহু তোমার মত না হত? তাহলে আজ বিশ্বাস করতে?
মায়ার জিজ্ঞাসা নোমানকে বোধকরি নিয়ে গেলো নিরুত্তরের অন্ধকারে।দুই পা দূরে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ একটি ভুলের সীমাহীন দূরত্বের আড়াল রয়ে গেলো জনকের পরিচয়।
বাকশক্তিহীন নোমান দেখে, ছেলে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে উঠতেই অন্য প্রান্ত থেকে দুহাত বাড়িয়ে, কে একজন এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে, আনিস, মাই বয়!
নোমান আত্মবঞ্চনার কণ্ঠে বলে, আনিস?
হ্যাঁ, আমার ছেলের নাম আনিস মনজুর।কাকা রেখেছেন ।
বাবা আর ছেলে এগিয়ে আসে।মায়াকে বুকের ভিতরে জড়িয়ে নিয়ে ছেলের বাবা বলে, মায়াবী, আনিস বললো, তুমি পারকিং টিকেট খুঁজছো? আহা,হারিয়ে গেলে গিয়েছে। হারানো জিনিষ খুঁজতে সময় নষ্ট করে কী হবে!
মায়া বলে, না, মুশফিক পেয়েছি।
তাই বলো, নিজ থেকেই ধরা দিলো? তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে কোথায়? কী হলো এত গোমড়া মুখ কেন, আরে বাবা একটু দুষ্টামি করলাম।
মুশফিক মায়ার কপালে আদর করে বলে, চল বাড়ি যাই।
এই মুহূর্তটা সময়ের কাঁটায় এক মিনিট পার না হলেও, নোমানের মনে হলো সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে - ওদের মাঝে অস্তিত্বহীন একজন হয়ে।
টার্মিনালে আগন্তুকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নোমানকে পিছে ফেলে ওরা তিনজন বের হয়ে যায়।বাবা ছেলে রাস্তা পার হয়ে গেলো।মায়া দাঁড়িয়ে থাকে।
ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি সবুজ থেকে লাল হয়ে যায়।মায়া পিছে ঘুরে তাকাতে গিয়ে থেমে যায়।কাচের দরজার ওপারে নোমানের দাঁড়িয়ে থাকা বড় বেশি স্পষ্ট- মায়ার মন বলে, নোমান দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে।
মায়া কী ঘুরে তাকাবে? নোমান কেন এয়ারপোর্টে ? কাকে নিতে এসেছে ? ও কী নিউ ইয়র্কে থাকে? না, মায়ার কোন প্রশ্ন নেই।সাত বছর আগের একটি প্রশ্নের চাপে সব প্রশ্নে যে অর্থহীন। লাল থেকে সবুজ সিগন্যাল বাতি জ্বলে।রাস্তার ওপারে ছেলে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে।মায়া রাস্তা পার হয়ে ওঁদের কাছে যায়।
গাড়িতে উঠেই আনিস বলে, বাবা আজ রাতে আমার সাথে থাকবে। মায়া চমকে ওঠে, আনিসের কথা বলার ধরণ কী তাহলে...
ঠিক এভাবেই যেন সাত বছর আগে নোমান বলেছিলো, আজ রাতটা আমার সাথে থাকবে।
কেন?
কারণ,আমি কবে ফিরে আসতে পারব জানি না।
কার্নিশের গায়ে হেলান দিয়ে মায়া ফেব্রুয়ারিতে পরিয়ে দেওয়া আংটি ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, কালই যেতে হবে? একটা দিন থেকে গেলে খুব অসুবিধা হবে? কাল না হয় কোন কাজীর অফিসে যাই?
মায়া, কি বলছিস? লোক মরছে, বিধবা হচ্ছে, এই সময় কাজীর অফিসে? কেন আমি তোর স্বামী না? রেজিস্ট্রি না হলে যদি আমি তোর স্বামী না হই, তাহলে আমি মরে গেলে তুই বিধবাও হবি না।
মায়া উঠে যেতেই নোমান বলে, রাগ করিস না।কথাটা তুলে নিলাম।তোর জন্যই ঠিক ফিরে আসবো।
পঁচিশে মার্চের রাতে বন্ধুদের সাথে নোমানের হলেই থাকার কথা ছিলো। সেদিন মায়ার জ্বর থাকায় ও গেলো না। সেই রাতে হলের রুম থেকে ওর কোন বন্ধু বের হতে পারে নাই। গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে একে অপরের বুকে পিঠে পড়ে শেষ নিশ্বাস নিয়েছে।
নোমান তো সেদিন রাতেই শেষ হয়ে যেতে।
নোমান সিগারেটের জ্বলন্ত গোড়া স্যান্ডেলে পিষে মায়ার গা ঘেঁষে বসে। মায়ার ঘাড়ে হাত রেখে বলে, এই ছাদে আমাদের পায়ের ছাপ কত বছরের? বিশ?
না উনিশ।আমরা তোমাদের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে যখন আসলাম তখন আমার এক বছর আর তোমার ছয়।কতবার মনে করিয়ে দিতে হবে?
যতবার ভুলে যাবো ততবার তুই মনে করিয়ে দিবি। আমি ভুল করবো তুই শুধরে দিবি।
মায়া নোমানের বুকে মাথা রেখে বলে, বেশি ভুল করো না।এখন যাই। বাবাকে খাবার দিতে হবে।
নোমান মায়ার চোখের সামনে হাতঘড়ি তুলে বলে, এখন রাত আটটা বাজে। ঠিক এগারোটা বাজলে এখানে আসবো।পাঁচ মিনিটের বেশি দেরি করলে মেরে ফেলবো।
মায়া নোমানের হাত ধরে উঠতে উঠতে বলে, উনিশ বছর ধরে শুধু মারতেই চাইলে, পারলে না।কথাটা কবে ফলাবে তুমি কে জানে।
নোমান মায়ার কপালে চুমু খেয়ে বলে, ফিরে আসি, তখন দেখবি।
সিঁড়ি ভেঙে একতলায় যাওয়ার আগে মায়া একবার দোতালায় নোমানের মায়ের কাছে এলো।
মা কাকী, ডাল রেঁধেছো আজ ? এক তরকারি দিয়ে আর খেতে ইচ্ছা করছে না।
মায়া মা, এমন করে বলতে নেই।তাও ভালো এর ওর বাগানে সবজি আছে এখনও। যার যার বাড়িতে মুরগী ছিলো সে তো প্রায় শেষ। নোমান কতদিন বাদে এলো। না খেয়ে শরীরের কী হাল হয়েছে, দেখেছিস তো। আমার শেষ মুরগীটাকে জবাই করতে হলো। কী সুন্দর রাত পোহালেই ডাক দিতো।
নোমান কাছে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, কে বলেছিলো তোমাকে ওর গলায় ছুরি চালাতে?
ঘাস লতাপাতা খেয়ে চলিস, ভাবলে যে আমি মুখে কিছু দিতে পারি না।
মায়ার হাতে বাটি তুলে দিয়ে নোমান বলে, মা এই মেয়েটা তোমাকে মা কাকী কেন ডাকে? তুমি কী হও ওর?
বাবা, এই ঘোর বিপদেও তোর ঠাট্টা যায় না।হ্যাঁ রে তোরা কি যুদ্ধ করতে করতে এমন ধারার কথা বলিস?
হ্যাঁ বলি, তবে বলি পাক্কুগুলোকে নিয়ে।তুমি বিশ্বাস করো ওদের গায়ে শক্তি আছে ঠিক, তবে মাথায় ঘিলু কম।
ঘিলু কম বলেই তো এমন কাজ করতে পারলো।
তুমি দেখো, আমরা জিতবই।
ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, জেতার পিছে কত ধরনের ধ্বংস সহ্য করতে হবে কে জানে।
এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট পরে না, আরও আগেই মায়া কাঁথা আর বালিশ নিয়ে আসে। ছাদের এককোণায় ছোট ক্যাম্পখাটের উপরে রেখে কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, সংকটময় দেশের মাথার উপরে আকাশটা কি ভীষণ শান্ত। মায়ার গলা ধরে আসে – এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? স্বাভাবিক হবে কী সবকিছু ? কোথায় স্কলারশিপ নিয়ে সেপ্টেম্বরের সেশন ধরার জন্য নোমানের অ্যামেরিকায় যাবার কথা। যাবার আগে বিয়ে। সব এখন ভাগ্যের অজানা অপেক্ষায়।
নোমান এপ্রিলের দশ তারিখে এখানে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, মায়া, আমাকে যেতে হবে।মায়া কেঁদেছিল অনেকক্ষণ।নোমান বাধা দেয়নি। বলেছিলো চোখের পানি সবসময় বৃথা যায় না রে । কখনও ভিতর থেকে মূল্যবোধকে ধুয়ে মুছে আনে। ভেবে দেখ, ঘরে বসে থাকার সময় এখন?
মায়া, তুই ভীতু, নরম মনের মানুষ তবুও বলি এখন সময় এসেছে সাহসী হয়ে ওঠার। নিজের ভিতরে শক্তি আছে সেই বিশ্বাসে ভর করে চলতে হয়। বাড়িতে তোরা চারজন।তোর উপরে আমি ভরসা করতে চাই।
সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ।মায়া চট করে চোখ মুছে নিলেও নোমান ঠিকই টের পায়। মায়াকে কাছে টেনে বলে, অপেক্ষায় বসে আছে আমার অন্তকালের প্রেম- এই দৃশ্য যে এই জগতের সেরা দৃশ্য!এমন করেই অপেক্ষায় থাকিস।তবে আমি যদি পঙ্গু হয়ে ফিরে আসি, তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবি না।বোঝা হয়ে থাকার চাইতে অদৃশ্য ভালোবাসায় থেকে যাবো।
রাতের অন্ধকার কেটে যায়নি।মায়া তখনও ঘুমিয়ে।মায়ার শরীরের প্রতিটি বাঁক নোমানের চেনা, তবুও কালরাত যেন ছিলো প্রথম, ছিলো সর্বশ্রেষ্ঠ রাত। মায়াও এত বেশি সপ্রতিভ আগে কখনো হয়েছিলো কী?
নোমানের গলা ধরে এলো।ফিরে আসবে তো সে ? কোথায় কী পেঁচা ডেকে উঠলো?
মায়া মায়া, দুবার ডেকেও মায়া চোখ খুলছে না দেখে, নোমান মায়াকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে বলে, পাগলী চুপ করে থেকে আমাকে আটকাবার কথা না ভেবে,উঠে বস।
কখন যাবে?
এখন চারটা বাজে, একঘণ্টা পরে।
আমি যাই চা নাস্তা নিয়ে আসি।
নোমানের দুই সহযোদ্ধা সময় মত দুধ বিক্রেতার সাজে এসে দরজায় টোকা দিলো। নোমান নিচে নামতেই দেখে মায়ার বাবা দাঁড়িয়ে। নোমানকে কাছে টেনে কিছু বলতে গিয়ে পারলো না।নোমান জানে এই মানুষটার কথা অব্যক্তই থেকে যায়।
মায়া ছাদে দাঁড়িয়ে।নোমান ফিরে তাকায়।এক পা বাড়িয়ে আবার ফিরে তাকায়। নোমান দাঁড়িয়ে পড়তেই বন্ধুরা অস্থির হয়ে ওঠে।নোমান হাত তুলে মায়াকে চলে যেতে ইশারা করে, ওদের সাথে পা বাড়ায়।মায়া আড়াল থেকে নোমানের চলে যাওয়া দেখলো।
কে জানতো, বিধির লিখনে ছিলো নোমানের সেই যাওয়াই মায়ার জীবন থেকে চলে যাওয়া!
আজ ছয় বছর পরে এই এয়ারপোর্টে বিধির অদৃশ্য লিখনের আরও একটি অংশ দৃশ্যমান হয়ে এলো- অখণ্ডিত বিধি নোমান’কে না যেতে দিলো, না ফিরে আসতে দিলো!
নোমানের সেদিন চলে যাওয়ার ঠিক এক মাসের মধ্যে ঘটে গেলো আরেক ঘটনা।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার ছয়মাস পরে কী মনে করে মিলিটারিদের ইচ্ছা হলো এড়িয়ে যাওয়া এই এলাকাটা একটু দেখা দরকার।এই পাড়াতে একদুই ঘর হিন্দু থাকলেও তারা তাঁদের ঘরে তালা মেরে সীমান্তের ওপারে চলে গেছে এপ্রিলের শুরুতেই।
মিলিটারিদের আসার সম্ভাবনা কম আন্দাজ করে মহল্লাবাসি মুক্তিযোদ্ধাদের ঠাঁই দিতে সাহস করেছিলো। ছেলেরা আসতো, পেটে কিছু দিতে,একটু ঘুমাতে।
সকলের আন্দাজকে তুড়ি মেরে একদিন ভরদুপুরে মোড়ের মুখে জিপ থামে, দুচার বাড়িঘরে তদন্ত শেষে নোমানদের বাড়িতে এসে কড়া নাড়লো দুইজন পাকআর্মি।
নোমানের বাবা দোতালা থেকে ওদের দেখেই, হুড়মুড় করে নিচে নেমে চাপা গলায় ডাকে, মায়া। খটখট আওয়াজ শুনে মায়ার বাবাও বের হয়ে আসে। হতভম্ব হয়ে দুজনে দুজনার দিকে তাকায়। দরজা না খুললে গুলি চালাবে। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে মায়ার বাবা দরজা খুলে দিলো।
দুজন আর্মি ভিতরে ঢুকে জানতে চাইলো বাড়িতে কে কে আছে।নোমানের বাবা উর্দু বলতে পারে না।বোঝেও সামান্য।যাদেরকে দেখার কোন ইচ্ছা ছিলো না তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাটাও ভুলে গেছে সে। রীতিমত তোতালাচ্ছে দেখে, ওরা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে, মায়ার বাবার দিকে তাকায়।
মায়ার বাবা ঝরঝরে উর্দুতে বলে, আমার নাম মোহাম্মদ আনিস। আমার মেয়ে মায়া আর আমি একতলায় ভাড়া থাকি। ইনি বাড়ির মালিক আহমেদ মনজুর। উনি এবং তার স্ত্রী মমতা বেগম দোতলায় থাকেন।ওঁদের একটি ছেলে, সে বিদেশে কাজে আছে।
মনজুর তার এত বছরের পুরনো ভাড়াটে, তার পরম আত্মীয় আনিসের দিকে তাকিয়ে ভাবল,ও তো মিথ্যে বলে নাই। তার ছেলে তো বিদেশেই আছে।কাজেই আছে।
আর্মিদের একজন বলে,ভিতরে চলো।মেয়েকে ডাকো।আনিস ওদেরকে দরজা দেখিয়ে বলে, আইয়ে।
মনজুর বুঝতে পারে তার এখন বাথরুমে না গেলেই নয়।আনিসকে বলতেই, সে মিলিটারিদেরকে বলে, ওর প্রস্টেট সমস্যা আছে।ওকে বাথরুমে যেতে অনুমতি দেও।
ওরা ইশারায় যেতে বলেই, আবার বলে,এখানে ফিরে আসবে।
বাথরুমের দরজার আড়ালে মায়া দাঁড়িয়ে ছিলো।আনিস মায়া বলে ডাকতেই, মায়া বের হয়ে বসার ঘরে আসে। মনজুর পাজামার গিট তাড়াহুড়া করে লাগিয়ে, ফিরে এলো বসার ঘরে।
মায়া দাঁড়িয়ে আছে এক মিলিটারির পাশে। আনিসের সাথে কথা বলছে আরেকজন। সে বুঝলো।একটা পরিষ্কার লেনদেন হতে চলছে।ওরা মায়াকে জিপে তুলবে না যদি আনিস ওদের সাথে মদত দিতে রাজি হয়। তা নাহলে যা হবে তার জন্য আনিস দায়ী থাকবে।
মায়ার দশ বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই মেয়ে ছাড়া আর কিছুই বোঝে না যে আনিস, সেই আনিস চুপ করে আছে।
মনজুর আনিসের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে,হ্যাঁ বলো।
মিলিটারিরা মায়ার হাত ধরতেই,আনিস বলে, আমার মেয়ে শুধু না, তোমরা এই পাড়ার কোন মেয়েকে নেবে না।আমি তোমাদের সাথে থাকবো।
এই মিলিটারির কী আনিসের তুখোড় উর্দু পছন্দ হয়েছিলো, এমন একজন ইনফরমার তাদের দরকার এই অঞ্চলের খোঁজ রাখার জন্য। এ পর্যন্ত তার ইনফরমাররা বাংলা মিলিয়ে যে উর্দু বলে তা সে আধা বোঝে, আধা বোঝে না।
মেজর ইমতিয়াজ এবার তার নিজের পরিচয় দিলো এমনভাবে যেন চাকরির নিয়োগপত্র দেবার সময় বুঝিয়ে দিচ্ছে সেই তার বস।সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলে, তুমি মাসে টাকা পাবে।
আমাকে টাকা দিতে হবে না। আনিস পরিষ্কার কণ্ঠে বলে।
মেজর রেগে গেলো ,না অবাক হলো, বোঝা গেলো না। বলে, তুমি কী করো?
আমি কলেজে পড়াই।আমরা মাত্র দুজন।খরচ কম।
তাহলে তুমি বেতন নেবে না?
মেজর,আপনি বুদ্ধিমান ব্যক্তি।বেতন দেওয়া হয় যখন চাকরির আবেদন মনজুর করে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। আমি তো আবেদন করি নাই। আমাকে আপনি দেশের জন্য কাজ করতে বলছেন। সেক্ষেত্রে বেতনের প্রশ্ন ওঠে না।
তাহলে তুমি পাকিস্তানকে ভালোবেসে কাজ করবে?
হ্যাঁ, আমার দেশকে ভালোবেসে কাজ করবো।
মেজর তার ভারী গোঁফ ছুঁয়ে সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,ঠিক হায়। তবে ইমান ঠিক রাখবে।
আনিস বলে,আমার ইমান ঠিক থাকবে।
মনজুর একটি অলিখিত নিয়োগপত্রের সাক্ষী হয়ে ভাবে, অন্তত এই মিলিটারির বুদ্ধি কম না। দাবার চাল সে ভালো জানে। যুদ্ধের বাজারে, নারীর অভাব হয় না।তারও নেই। অথবা হতে পারে নারীর প্রতি আকর্ষণ কম। তারপরেও তুলে নেওয়ার হুমকির কারণ, ওদের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার শক্তিশালী গুঁটি ছিলো মায়া।
আনিসের শর্ত মেনে এ তল্লাটের কোন মেয়েকে জিপে তোলে নাই সেদিনও না পরেও না।
মায়াকে ছেড়ে দিয়ে ওরা আনিসকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
সেই থেকে আনিসকে সকাল ওদের জিপ এসে নিয়ে যেত।বিকেলে বাড়ি পৌঁছে দিতো।
তবে ভাগ্য বলে যদি সত্যি কিছু থাকে তবে ভাগ্য আনিসকে প্রতারণা করে নাই। তিন মাসের মাথায় এক অপারেশনে এই মেজর মারা যায়। আনিস খুব ঠাণ্ডাভাবেই মনজুরকে যখন বলে, তখন মনে হয়েছিলো,এমনটা ঘটবে তা যেন আনিস জানতো। মনজুর জানার আগ্রহ দেখাতেই বলে, দেয়ালেরও কান আছে। তবে আমি কয়েকমাসের জন্য মায়াকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাবো। ভয় করো না।আমি চাই আমাদের সাথে তোমরাও চলো।বেশিদিন থাকতে হবে বলে মনে হয় না।
নোমান যদি আসে?
ওকে একটা খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করবো।
নোমান একমাস বনগাঁ হাসপাতালে থেকে ফিরে আসে - স্বাধীনতার পনেরদিন পার করে।
মায়া তখন প্রায় চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা। মায়া ছাদে বসে অপেক্ষায় ছিলো।দীর্ঘ অপেক্ষার পরে নোমানকে একান্তে দেখবে। বলবে আমার তলপেটে হাত রাখো, ওর অস্তিত্ব টের পাবে।
নোমান আসে নাই। সেদিন না,পরের দিন না।কোনদিন না।
অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থেকে,মায়া নিচে আসতেই নোমান আর কাকার তর্ক শুনে দাঁড়িয়ে গেলো দোতলার দরজার আড়ালে।কতদিন পরে নোমানের কণ্ঠস্বর। অথচ কত অন্যরকম,কত অচেনা। কী বলছে নোমান?
বাবা, একমাস ওদের সাথে থাকাকে মাত্র বলো না।আনিস লোকটিকে আমি ধরিয়ে দেবোই।
যদি তাই করিস তাহলে আমাকেও দে।আমিও সেদিন চেয়েছিলাম ও হ্যাঁ বলুক নয়ত আমার মায়া মা কে ওরা...
নোমান, তুই আনিসকে ধরিয়ে দিতে পারিস, কিন্তু এ পাড়ার সকলে ওর পক্ষে থাকবে। দেখে নিস।একবার ভেবে দেখ, যুদ্ধের ময়দানে নিরস্ত্র আমরা কিভাবে নিজেদের রক্ষা করে চলেছি।যার ঘরে মুক্তিযোদ্ধা ছেলে তার অবস্থা বোঝো বাবা। সেদিন যদি আনিস বুদ্ধি করে তোর কথা অমন করে না বলতো, তাহলে আজ আমার লাশও খুঁজে পাইতি না।আর মায়া? পারতি সহ্য করে মেনে নিতে, যদি সেদিন মায়ার ইজ্জত লুটে নিতো? হাসপাতালে বসে শুনলি আনিস পাকআর্মিদের সাথে হাত মিলিয়েছে,আর কিছু শুনলি না কেন?
এবার মা কাকী কেঁদে ফেলে বলে, নোমান, মায়া ছাদে বসে আছে তোকে নিজে বলবে বলে। ভাগ্যিস তোদের কলমে পড়া আক্দ করানো ছিলো। যুদ্ধ বাধল, মায়াকে বউ করে ঘরে তোলা হলো না।এখন যে সময় নেই দেরী করার। এসব ঝগড়া থামা।
মা, কী বলছো? মায়া কী বলবে? কিসের সময় নেই?
তুই যে বাবা হবি, বাপ আমার!
যুদ্ধ নোমানের মত মানুষকে বদলে দিতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ ঘরের মধ্যে দুজন দেখলো, আর বাইরে একজন জানলো।
যাত্রাপালার জল্লাদের মত করে হা হা হা করে হেসে উঠলো নোমান।
কি করে তোমরা ধরে নিলে, ওর পেটে আমার সন্তান? যাদের ঘরে মিলিটারির আসা যাওয়া ছিলো?
আসা যাওয়া? নোমান, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে নোমান? ওই একদিনের পর কোন মিলিটারির পায়ের ছাপ আমার বাড়িতে পড়ে নাই। তোকে আমি চিনতে পারছি না। আমার চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যা। আগে লিস্ট বানা তোর আঙ্কেলদের ,যাদের জন্য টিকে থাকা দুষ্কর ছিলো। পারবি না লিস্টে তাদের আনতে। ষোল তারিখের পরে তাদের এক কাঁধের বন্ধুক এখন অন্য কাঁধে। যাদের মুখে এতদিন ছিলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ।এখন তাদের মুখে উঠতে বসতে জয়বাংলা।
তোর যে সব বন্ধুরা এতদিন বাড়িতে বসে ছিলো। ষোল তারিখ সকাল থেকে তারা এখন মুক্তিযোদ্ধা। আরো শুনবি, লুটপাট মাস্তানির খুন খারাবির কথা ?
তোর কাছে রাতারাতি মুখোশ পরে যারা ঘুরছে, তারা স্বাধীনতা বিরোধী না। যে ক্ষতি করে নাই, যে নিজের জীবন বিপন্ন করে, আমাদের রক্ষা করেছে, সে দোষী?
মায়া নিচে নেমে এলো।আনিস জানতে চাইলো নোমান কেমন আছে।
হ্যাঁরে মায়া, আমার সাথে দেখা করতে এলো না? না থাক শরীরটা ঠিক হতে সময় লাগবে। আমিই যাবো ওকে দেখতে।
না বাবা, তুমি যাবে না। আমরা কাল সকালে এই বাড়ি থেকে চলে যাবো।আপাতত গ্রামে।
মানে?
জানতে চেয়ো না।তবে তুমি দোতলায় যাবে না।
আনিসের বোবা চোখের দিকে তাকিয়ে মায়া খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে, চলো খেয়ে নেই।
মায়া খাবার গরম করে, এক সাথে খেতে বসে।
প্রচণ্ড ঝড়ের তান্ডবতার পরে স্তম্ভিত চারপাশের মত মায়া গম্ভীর, শান্ত।
মায়ার এই আচরণে ভয় পেলো আনিস। নোমান সীমান্তের হাসপাতালে আছে। সেই খবর এলো মাসখানেক আগে।মায়া সেদিন সারাদিন পড়ে পড়ে কেঁদেছে।আর আজ নোমান আসতে না আসতেই কী হলো ? কখন হলো। মায়ার এই অবস্থায় নোমান কী করে রাগ করে থাকতে পারে?
বাবা, সেই তখন থেকে ভাত নাড়ছ, খাচ্ছো না কেন?
হ্যাঁ রে, আমার খুব একটা খিদে নাই।তুই আজ অনেক তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেলি।
ঠিক আছে। খেয়ো না।তবে কাপড় গুছিয়ে রেখো শোবার আগে।আপাতত একটাই সুটকেস নিও।পরে এসে বাকি জিনিষ নিয়ে যাবো।আমাদের তো এমাসের ভাড়া দেওয়াই আছে।
মায়া, আমি কী পুতুল মা ? কী হয়েছে না বললে আমি যাবো কেন ? আমি উপরে যাচ্ছি।
বাবা তুমি অপমানিত হতে চাইলে, যাও।
মায়া আর কথা বাড়াল না।ঘরে গিয়ে একটা ব্যাগ গুছিয়ে,শুয়ে পড়লো।
ভীষণ অসার লাগছে। চোখ জুড়ে ঘুম আসছে। মায়ার কানে ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ এলো।
আনিস, মায়া কোথায় ? মায়া কিছু বলেছে?
মনজুর, কী হয়েছে জানি না।মায়ার চুপ থাকা আমাকে কিছু আন্দাজ করতে দিলেও, আমাকে যখন ও বলবে আমি তখন শুনবো।এই মুহূর্তে ওর সিদ্ধান্তের পাশে আমাকে থাকতে হবে।
আনিস,মায়া আমার ছেলের বউ, তবে তার আগে ও আমার মেয়ে।এই বাড়িতে ওর অধিকার আছে। আমাদের কাছে ওর অধিকার আছে।নোমানের মাথার ঠিক নেই, ওর কথা ...,
মনজুর,আমাদের একটু সময় দরকার।তুমি অপরাধের গ্লানিতে ডুবে যেও না।
আমরা কদিন ঘুরে আসি গ্রাম থেকে।
দরজা পর্যন্ত গিয়ে মনজুর কপাটে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো।আনিস কাছে গিয়ে বলে, কি হয়েছে, মাথা ঘুরছে ?
আনিসকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মনজুর বলে এ কী হলো ? আমরা তো এক যুদ্ধে হেরেই গেলাম।এ দেখার চেয়ে পঁচিশে মার্চে কেন মরে গেলাম না।নিজের সন্তানকে বোঝাতে পারলাম না, চোখের সামনে নিজের মেয়েকে মরে যেতে দেখা যত সহজ তাকে ধর্ষণ করার জন্য একদল লোকের কাছে দিয়ে দেওয়া সম্ভব না।একজন অভাগা পিতাকে দেখতে হয় তার মেয়ের হাত ধরে আছে ধর্ষক।
আনিস, বাপ হতে হয় এই অক্ষমতা বোঝার জন্য?
মনজুর কান্না থামিয়ে বলে, না আমার ভুল হয়েছে।আমি কাঁদছি কেন? মনজুর হঠাৎ সব আবেগ ঝেরে ফেলে দিয়ে ডাকে মায়া মা, কই?
মায়া ওর ঘরে আছে।
মনজুর মায়ার ঘরে ঢুকে বলে,মা তোর সাথে আমি আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আছি।আমি বাধা দেবো না তোকে।যে ভালোবাসায় বিশ্বাসের অভাব থাকে
সেখানে সমাজের কথা ভেবে অপমান মেনে নিস না। তোর মা কাকী খুব ভেঙে পড়েছে।একবার দেখা করে আয়। হ্যাঁ রে মা একবার এই বাপের বুকে আয়।
কালরাত থেকে কাঁদে নাই মায়া।প্রাণপণ চেষ্টা করে সেই শক্তি ধরে কাকার বুকে মাথা রাখলো মায়া।
মনজুর বলে, আমাদের যদি দাদাভাই হয় তবে তার নাম হবে আনিস মনজুর। তোর এই দুই বাবা এক হয়ে সারা জীবন তোর সাথে থাকবে। তোকে সকল বিপদ থেকে আগলে রাখবে। এবার চল আমার সাথে। তোর কোন ভয় নাই মা, ওর তোর সামনে আসার সাহস নেই। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেই সাহসী হয়ে ওঠে না।বিনা অস্ত্রে যে লড়ে সেই সাহসী। আজ থেকে তোর লড়াইর শুরু।ও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে তুই বিনা অস্ত্রে মনের জোড়ে লড়বি।এই যুদ্ধ যে সত্য সামনে তুলে ধরেছে, এই তোর অর্জন।
পাশের রুমে আলো না থাকলেও মায়া জানে নোমান জেগেই আছে।যে ঘরে যেতে এত বছরে ধরে কোন বাধা ছিল না আজ সেখানে যে বাধার দেওয়াল দাঁড়িয়ে গেছে তা আর কোনদিন ভাঙবে না।অসংখ্য পেরেক তুলে ফেলা যায়।কিন্তু কিছু পেরেক এতটাই অদৃশ্য থাকে যা তুলে ফেলেও বন্ধ দরজা খোলা যায় না।
মা কাকী কান্নার দমকে কোন কথাই বলতে পারে নাই।মায়ার মাথায় ফু দিয়ে, পেটে হাত রেখে বলতে চেয়েছিলো বাচ্চার কথা ভেবে খাওয়া দাওয়া করিস।
মা কাকীর এত কান্নায় মায়ার চোখে জল আসে নাই।কে যেন বলছে,কাঁদবে না!
কে বলে? শরীরের ভীতরে যে সত্য বড় হয়ে উঠছে সে? মায়া শুখনো চোখে ধীর পায়ে বের হয়ে এলো দোতলা থেকে একতলায়।
ডিসেম্বরের শেষ সকাল।আনিস ভাবে স্মৃতিময় বিশ বছরের বাড়ি থেকে এ কোন স্মৃতি নিয়ে যাচ্ছে ? অপমানের জ্বালার তল থেকে উঠে আসছে ভালোবাসা।কালরাতে কতবার মনে হয়েছে নোমানকে সেই আগের মত বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,আনিস কাকুকে এত ভুল কী করে বুঝতে পারলে? কত কথা ছিলো তোমাকে বলার।
ইচ্ছা হয়েছিলো মায়াকে বলে,একবার ওর কাছে যাই।খুলে বলি সব। তারপরও ও যদি আমাকে ভুল বোঝে বুঝুক। কিন্তু তোকে ভুল বুঝে ও কী ভালো থাকবে? মায়ার কাছে গিয়েও বলতে সাহস হয়নি।এ যেন অন্য, অচেনা মায়া।
দরজায় তালা দিতে গিয়ে আনিসের হাত থেকে চাবি পড়ে গেলো। মায়া হাতে থেকে চাবি নিয়ে লাগিয়ে দিয়ে বলে, চলো।আনিস অবাক হয়ে দেখে একটুতে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়া মেয়ের চোখে কোন জল নেই। পাথর হয়ে গেছে মেয়েটা। কিন্তু পাথরও কী এতটা মৃত পাথর হয় যে বৃষ্টির ফোঁটাতেও ভেঁজে না?
গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে মনজুর বসা।আনিস জানে বলে লাভ নেই। সে যাবেই। মায়া আর আনিস পিছনের সিটে বসলো।ঢাকা শহরের চেহারা বদলে গেছে।মিলিটারিদের গাড়ি নেই। অত সকালে বিজয়ের মিছিলও নেই।কাকতালীয় মনে হল আনিসের। কোন বিজয়ের মিছিল আসবে তার জন্য!
ওরা দেখে সব দোকানে, বাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা উড়ছে।পথচারীরা নির্ভয়ে হাঁটছে। এত নির্ভয়তার মধ্যেও যেন একটা গুমোটভাবে – হাহাকারের অস্পষ্ট ক্রন্দন। কারা কাঁদছে?
ভূমিষ্ঠ হবার পরেই যেমন নবজাতক কেঁদে ওঠে তেমন – নতুন আলোতে টিকে থাকার কান্না। বাঁচবে তো শিশুটি ? কেমনভাবে বাঁচবে ? আর রক্তপাত দেখে ? ভাইয়ে ভাইয়ে হিস্যা মেটাবার জন্য ? বিশ্বাস অবিশ্বাসের ফাটলে পড়ে জন্মে নেওয়া শিশুদেশটি স্বাধীনভাবে বড় হবে তো?
আজ তো ওদের বাড়িতে মহা উৎসব হবার কথা ছিলো।সে উৎসব স্বাধীন দেশে পা দিয়েই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
আনিস নীরবতা ভাঙার জন্য বা মনজুরের সাথে কঠিন বিষয় আলাপ করার অভ্যাস থেকেই হোক, বলে, মনজুর ভাবছি ভাড়াটেকে বলবো দুই চার মাসের মধ্যে বাড়ি খালি করে দিতে।
মনজুর ভাবে কথাটি আনিস শোনালো মায়াকে।ঢাকা শহরে আনিসের বাড়ি থাকলেও এই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারে নাই।মায়ার কাছে এই বাড়ি নিজের বাড়ি ছিলো।
আনিসের প্রস্তাবে কেউ নড়েচড়ে উঠলো না। আনিস নিজেও কী উত্তর চেয়েছিল?
কমলাপুর রেল ষ্টেশনই বা এত জলদি চলে এলো কী করে।সবকিছুতেই যেন সময় কম লাগছে।
নয়মাস সময়ও গড়িয়ে ধাত্রীর হাতে মায়ার ছেলের জন্ম নিলো।মনজুর মমতা আগে থেকেই চলে এসেছিলো।
যুদ্ধোত্তর গ্রাম শহর সবই পালটে গেছে। যাবারই কথা তবুই মনজুর আর আনিস ভাবে,বাঙ্গালী জাতি কী এতটাই হতবাক হবে বলে ভেবেছিলো? যে ছেলেদের সাহসী ভূমিকার জন্য নিরাশার মধ্যে আশার আলো দেখেছিলো, তাঁদের ভূমিকা আবার যখন দুঃসাহসের সীমা ছাড়িয়ে গেলো তখন জোরে না বললেও নিশ্বাস চেপে রেখেই বলে হায়রে স্বাধীনতা! হাতে যুদ্ধের অস্ত্র থাকার এই ফলাফল ? এতদিন পাকিস্তানি জালিমদের বিরুদ্ধে এককাঁধে লড়ে, এখন তারা স্বাধীন দেশের মাটিতে ফাটল ধরিয়ে দিলো।গড়িয়ে পড়ছে নূতন রাজনীতির খেলার রক্ত।যারা ফাটলের কোন পাশেই দাঁড়াতে পারলো না তারা কোথায় হারিয়ে গেলো।
যারা শুধু দেশকে বাঁচাবে বলেই যুদ্ধে গিয়েছিলো, অস্ত্র ফিরিয়ে তারা ঘরে ফিরে গেলো। ফিরে গেলো যার যেখানে ফিরে যাবার।
রাশিয়া হাত বাড়িয়ে দিলো স্কলারশিপের। সুযোগ নিয়ে অনেকেই চলে গেলো রাশিয়ায়।
নোমান যুদ্ধের জন্য আঁটকে থাকা স্কলারশিপ ফিরে পেয়ে চলে গেলো অ্যামেরিকায়। বাচ্চা নিয়ে মায়া আনিস চলে এলো ঢাকায়।নিজেদের বাড়িতে। মনজুর মমতার ঘনঘন আসা যাওয়া বেড়ে গেলো।শুধু নোমনের নাম ওরা এড়িয়ে যায়।
বছরের পর বছর যুদ্ধের কবলে পড়া মানুষ যেমন অস্থির হয় না। চোখে ধ্বংসস্তূপ সয়ে যায়। রক্তপাত, মৃত্যু সয়ে যায়। পেটের খুদা সয়ে যায়। সব অনাচার স্বাভাবিক মনে হয়।অতীত জীবনের স্মৃতি তখন স্বপ্নে দেখা গল্প হয়ে ওঠে।মায়ার অতীত এখন গল্প।যে গল্পের সবটা মুসফিকের কাছে প্রথম বলেছে।
নোমান চেয়েছিলো মায়া সাহসী হয় উঠুক।মায়ার জীবনের আকস্মিক যুদ্ধও তেমন সয়ে নিতে নোমানের একটি ইচ্ছা নিজের অজান্তে মেনে নিয়েছিলো -মায়া সাহসী হয় ওঠে। সময়ের অদ্ভুত চালিকা শক্তি মায়াকে সঙ্গে নিয়ে চলে। শেখায় জীবনে যত বড় আঘাত আসুক, হয় তা ফেলে রেখে বা সঙ্গে নিয়ে চল।সময় মায়াকে বলে, তুমি বসে থাকলেও আমার থামার নিয়ম নেই।ঘড়ির দোলক মায়াকে দিয়ে মাস্টার্স করালো। চাকরি করতে করতে মুসফিকের হাত ধরতে শেখালো।মুসফিকের সাথে চার বছরের আনিসকে নিয়ে অ্যামেরিকায় থিতু করে দিলো।দুঃসময়ে পার করে দেওয়ার জন্য সময় তার সাথেই থাকলো।
এয়ারপোর্ট থেকে একটানা গাড়ি চালিয়ে লং-আইল্যান্ডের বাড়ির এক্সিট নিতেই মায়াকে গাড়ি থামাতে হলো স্টপ সিগন্যালে। মায়া রেড লাইটের দিকে তাকিয়ে ভাবল তার কী জানা দরকার ছিলো মা কাকী কাকার মৃত্যুর খবর পেয়েও কেন নোমান যায়নি?
জানতে চাওয়া দরকার ছিলো, কী ভাবে বেঁচে আছো তুমি নোমান ? পনেরো আগস্টের প্রত্যূষে মুক্তিযোদ্ধাদের আঠারোটি বুলেটের আঘাতে জাতির পিতার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে গড়িয়ে পড়ার খবর শুনে তুমি কার কাছে কেঁদেছিলে? আমরা কেঁদেছিলাম।আমি কেঁদেছিলাম তোমার জন্য।
গাড়ির পিছন বসে আনিস আধাঘণ্টা ধরে বাবার সাথে গত একমাসের সবকথা বলা শেষ না করতেই মায়া বাড়ির ড্রাইভওয়েতে গাড়ি পার্ক করে। আনিস নানাভাই বাবা ইস হিয়ার বলে, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা নানার কাছে ছুটে যায় । মুসফিক গাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে থেমে যায়। মায়ার কাঁধে হাত রেখে বলে, মায়া, গাড়ি পার্ক করে বসে আছো কেন? সারাক্ষণ চুপ করেই ছিলে।শরীর খারাপ?
মুসফিকের হাত ধরে মায়া কাঁদে। বলে, পরে বলি?
অলংকরণঃ তাইফ আদনান