জলধি / কবিতা / লালনপর্ব
Share:
লালনপর্ব

এক

‘তুমি খোদার নাবিক,পাড়ের মালিক
সেই আশাতে চড়েছি নায়
গুরু তোমার নাম লয়ে তরী ভাসাইলাম যমুনায় ।।’

অরূপকণ্ঠী চেতনা এক। সতত সরল চিন্তাগামী।
নিত্যভাগ্য মেনে চিনেছে যে পথ-অন্তরীক্ষের।
গন্তব্য গুরুবাক্য সমাধাকাক্সক্ষা মনোরথে...পরমাত্মাধামে
কলহ গণিতে মজে না মনপবন ত্রিধারার করুণ সঙ্গীতে।

প্রশ্বাসে কে আর থাকে মুহূর্ত গোপন?
বিশ্বাসী বয়ান যেমন মুখরতা নয়
করে কোপিনী ধারণ মননে মগজে কেউ পায় মুখোশের মায়া
জীবন্মৃত বেশে সে গেঁথে নেয় সুবর্ণ পালকের ঝুমুরবিলাস
গুণিতক ভুল করে ক্ষয়ে যায় বয়সী মাচান।

স্বরূপ চিনেছে ভোর দেখা সে চোখের নিরুত্তাপ সাহস
অহোরাত্র জেগে থাকা মুখচ্ছবিতে  লেগেছে ঘুম
চাঁদ-চকোরার দীর্ঘবয়ান গুরুপন্থি দৈনযাত্রায়।


দুই

‘মূলাধারে মূল সেহি নূর
নূরের ভেদ অতুল সমুদ্দুর
যার হয়েছে প্রেমের অঙ্কুর
ঐ নূর ঝলক দিচ্ছে তারি’

সহজ নয় তো মোহনটানে ধ্রুবকালের রথে যাওয়া
পরম মায়ার ঘোর-বিভোরে লেপ্ট থাকা জল-সাহসে
দারুণ দহনকালের শেষে রপ্ত থাকা ধ্যানিযুগের মরমীয়ায়
পাপ-পূণ্য আবে হায়াত অমৃত এক নগ্নবেলার মৌন সময়।
অটল প্রাণের ঘর-দুয়ারের বিষাদ-প্রতীম সুরম্যযুগ

ওই দুরন্ত আদ্যোপান্ত প্রানবন্ত অশ্ব-জাতক
আটকুঠুরি'র দরোজাতে দাঁড়ায় সে কেউ
আপ্তকালের দ্বৈতরথে মগ্ন মাতাল রাত্রি কাঁপন
সময়যানের অহম্ থেকে যাচ্ছে সরে রঙ সমাহার।

অবেলায় কোথাও কাঁপে নিমগ্ন সুখ,পদ্মযোনি!
শান্তরতি'র পাপড়ি দোলে দুর্বিনীত হাওয়ায় যেমন;
সেবাদাসীর পাগলপারা মুহূর্ত এক জ্যোৎস্নাভাসান।


তিন

‘কে কথা কয় রে দেখা দেয় না
নড়েচড়ে হাতের কাছে,
খুঁজলে জনমভর মেলে না’

হে সাহস চিহ্ন-দাম্ভিক! থাকো সাক্ষী প্রত্যাবর্তিত জ্ঞানে
সত্যাশ্রয়ী মনুষ্য-কথনে উদ্ধৃত হও মুগ্ধÑরণনে
অস্পৃশ্য ছিলে ঘোর প্রজ্ঞায় বিয়োগান্তক রোষে
ভালোবাসা থেকে যোজন দূরত্বে যাও প্রবর সুধাময়ী
সারাদুপুর তৃষ্ণা পড়ে থাকা একাহারী পাখিদের নিদ্রিত আশ্রমে,
এ আলোর অক্লান্ত হাওয়ার মোহে দেখিয়েছো সংসার নদীবৃত্তের।
 
কে শোনাও আঁধার কালের গান?
শাদাটে করচিহ্ন ছুঁয়ে এইবার মগ্ন হোক স্বরচিত চরাচর
অপরূপ দেহযাত্রা শেষে চোখের কার্ণিশে নামুক পরিত্রাণের ছায়া।


চার
 
‘আটকুঠুরি নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার ওপরে সদরকোঠা
           আয়নামহল তায় ।।’

ডানাঘেরা দুরন্ত ছায়াবোধ ঝরে গেছে মধ্যপ্রহরে।
পাখিহীন রাত জুড়ে বিবৃত গোপন কবিতা
করতলে তন্দ্রার শব্দ।প্রবর্তিত নির্জনে কে খোঁজে সৌম-প্রশ্বাস!
আলোচ্য অন্তরীক্ষ জুড়েই থেমেছে নক্ষত্র-নৈবদ্য    
মাটিদেহের এ সংসার ছুঁয়ে নামে রাত-মধ্যমা।

একতারা ভেঙে পরে...
সাধক-তর্জনী বেপ্যে কুয়াশা; ভেসে আসে মূক আলোয় বিমূর্ত রেখা-ছবি
নির্বোধ কঙ্কালবেশ সাক্ষী থাকুক নৈশব্দ্যিক দ্রাঘিমা-ছায়ায়
আত্মমোহে ঝরে প্রমত্তামুখর পরিকীর্ণ পাখিবেশ।
জে¦গে থাকে নারীফুলের কামগন্ধী সুবাস-আদিম

ছেঁউড়িয়া জে¦লেছে শান্ত-পিদিম নিখাদ শব্দ-সর্বনাম!


পাঁচ

‘গিরাম বেড়ে অগাধ পানি
ও তার নাই কিনারা নাই তরণি পাড়ে
বাঞ্ছা করি দেখবো তারে
কেমনে সে গায় যাইরে ।। ’

ভবকাল গেছে মোহে,মহোৎসবে
ঢের আগেই পরম্পরা বিশ^াসের আদলে ডুবে যাওয়া এই সুর,
জানে পলাতক তৃষ্ণার দূর্ভেদ্য ক্ষত; একতারা অমনিবাস।
নিউরণে দূরত্ব বাড়ে, নেচে ওঠে হাওয়াদোলনার অনন্ত বিভা
চেনা-অচেনার দ্বিধায় ডুবেছে মুগ্ধ রোদনের শেষ ওঙ্কার
খুব গোপনে পুড়ে যায় আখড়াই প্রহর, বোবা আহাজারি।

ওপাশে পদ্মমধু-গায়ে আসে ঋতু’র জোয়ার
কামুক সাধনসঙ্গিনী খোঁজে শৃঙ্গারের গহীন ছবক।
দেহতত্ত্ব জ্ঞান প্রত্যাশা রয়ে যায় শাদা কৌপিনে,
পাঁজরে বয়ে যায় গঙ্গা-যমুনা,ঈড়া-পিঙ্গলা... 



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন