পর্ব ০১।।
আসলে ঘর বলতে আমি বহতা নদীর উদারতাকেই বুঝতে শিখেছি। অনেক দূরে-দূরে ঘুরে ক্লান্ত ফেরিওলা ঘরে ফিরে যায় একটি দোরের কাছে। যে-দোরের প্রতিটি পরতে-পরতে আঁকা– কাছে ফিরে আসার হাতছানি। চোরাটান কি শুধুই দেবতাহীন নৈঃশব্দ্যদের যৌথ আরাধনা? কিংবা কুঝিকঝিক বৈশিষ্ট্যের আবরণে হারিয়ে-যাওয়া বৈপ্লবিক কৃষ্ণষাঁড়ের ঘরদুয়ার?
একহারা রোদের ঈষদুষ্ণ হাড়মাস এন্তার পরিপুষ্ট হয়েছিল শীতাতাপ-নিয়ন্ত্রিত বৃষ্টির বিস্তর কঙ্কালে। ভাঙাহাঁড়ির দুর্দশা-মতো আঁধার নামে কখনো জোছনার হালনাগাদ খামখেয়ালিতে ডুবে। এখনো কি ফোটে না চতুর্ভুজ শহরের দৃশ্যহীন ঝুলন্ত উদ্যানে লণ্ঠনের আলোতে-পরিশীলিত গোত্রহীন কোনো হলুদ ফুল? অন্যদিকে ময়ূরপুচ্ছ-পরা কাকগুলো বনফুলের খামার ছেড়ে কাঠপুতুলের নানা সহনশীলতা পুঁজি করে দেশান্তরে চলে গেল।
প্রামাণিক এই আমি চিরকালই এলোমেলো। একটি স্বীকৃত বিছানা। বিছানার ওপর অকাতরে সঞ্চারিত ফররুখ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী। ঋষিজ প্রচ্ছদগুলো থেকে লতিয়ে-ওঠা ভালোলাগার লতাপাতা মনের কায়ায়-ছায়ায় প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। কবিতা, তুমি আমার অব্যক্ত ঝরনাধারার কপোতসুলভ আত্মবিশ্বাস।
মহেষ্বাস সময় বয়ে যায়। তবুও খরস্রোতা ঢেউয়ের ধারাবাহিকতায় দেবদাসের কথাগুলো আমার কানে আছড়ে পড়তে থাকে, ‘আলাল, দোস্ত আমার। তোর ঝাক্কাস লাল শার্টটা ধার দিবি? সবিতাদিকে নিয়ে পরানসখি টকিজে একদিন বুলবুল-কবরীর ছবি দেখতে যাব।’
আমলকীবনের কোথাও কি ঘুমকাতরে পরিচালকের ন্যূনতম ক্যামেরা পড়ে আছে? শিশিরের মতো টলটলে প্রখরতার সবুজ রঙ ভারি বুটের নিচে কাতরে উঠেছিল। একজন অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দার চোখে একজন উদ্বাস্তু হরবোলার আরণ্যক ছদ্মবেশ কখনোই অপ্রতিদ্বন্দ্বী কাচের হীরে হতে পারে না। এল উল্কি-আঁকা ইউটিউবের নৈর্ব্যক্তিক যুগ। বন্ধুরা কেউ এখন আর আষাঢ়ে-গল্পের পূর্বাপর আসরে যায় না। রাতদিন আপামর মোবাইল টিপেটিপে স্বেচ্ছা-গৃহবন্দি হয়ে লাল-নীল ঢেউ গোণে। আমি থেকে যাই সাক্ষ্যতুল্য এক-গন্ধকুটিরে।
সশরীরে মানবজাতির অর্ধেক কায়া নিতান্ত মূল্যে কিনে মাংসাশী ঝুলিতে ভ’রে চলে গেছে কোনো এক-বাণাসুর দৈত্য। শুধু প’ড়ে আছে সেই কায়ার নাতিদীর্ঘ মায়াময় ছায়া বিপন্ন পথেপ্রান্তরে-লোকালয়ে। দেবতাদের উন্নয়নমূলক দৃষ্টির আড়ালে কখনো থেমে থাকে না কর্তৃত্বপ্রিয় শোক কিংবা বিষাদের নতজানু জলসা। মাঝেমাঝে সুবিন্যস্ত হাওয়া বয় শোণিতপূরে। সুখ তুমি মৃদঙ্গময়। অমনি বও। কুমড়ো ফুলের শিহরণ নিয়ে কেঁপে-কেঁপে ওঠে পরিচিত-অপরিচিত আনন্দ-উদযাপন, জীবনজয়ের তাড়না।
মননশীল আকাশ থেকে সনাতন একটি তারা খসে পড়লে, তুমি শোবার ঘরের বালিশের কানে-কানে বলো, ‘অক্ষহীন হলেও, ভালোবাসা কক্ষনো একেকটি বকলম বদ্বীপ নয়।‘ কাবেরী নদীর তীরে প’ড়ে-থাকা টিপু সুলতানের তীর একটুকরো রোদ্দুর হয়ে কোথাও কি দীপ্ত দিগন্ত এঁকে দিল? দক্ষিণের বাতাসে ভর করে শীতের কফিন-কফিন কুয়াশা। কিছুদিন কাটাবে কি উত্তরের তালবিথি-আঁকা তেপান্তরে? রুপাঞ্জেলের রাঙা পদচিহ্নগুলো মুছে গেলে, ধুলোদের হৃদয়ে সর্বনাশ রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল। এইসব এপিটাফ কেবলি ডেকে আনে সান্ধ্য আড্ডার অলসতা, মহিষের শুষ্ক চারণভূমিজাত অন্ধকার-প্রবাহ।
বন্ধ দোরের পাশে পড়ে-থাকা সনির্বন্ধ শ্যাওলারা একসময় পড়োবাড়ির পরমাত্মা হয়ে উঠেছিল। চিত্রলেখা, ঊষাময় পায়রাকে উড়িয়ে দাও দ্বীপান্তরে। আবার তাকে কোন মায়াজালে বন্দি ক’রে কারুকলার নামে দীক্ষা দাও যুদ্ধজয়ের দূতিয়ালি? একটু পেছনে ফিরে তাকালেই দেখতে পেতে, এই অবেলায় সবিনয় ছাতা হাতে নিয়ে তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি সবিশেষ।
নির্নিমেষ শালপিয়ালের নীলসাগরনীতি সম্পর্কে আমার কিছু কথা আছে। তার আগে বলে নিই, উড়ালসড়কের সুশীল উচ্ছ্বাস তো পশ্চাৎপদ ঝরাপাতাদের কাছ থেকেই চেয়ে-চিন্তে নেয়া।
আহা! অনাবিল আকাশের জাফরানি আডাল জাফরি-কাটা আলো-আঁধারিতে কী ঐন্দ্রজালিক হয়ে উঠেছে! এক-হাঁটুভাঙা লাইটপোস্টের অনির্বাণ দুর্দশার সঙ্গে অনমনীয় মিল আছে এমন শুকিয়ে-যাওয়া জলধিতে শামুকের গতিবিধি দেখি। পাথুরে ঠাণ্ডা ঘরের লোমশ ব্যাপকতা নিয়ে রাত্রি কালো ম্যামথের মতো নিশপিশে। বাতাসী বুলেটের সশব্দ তীক্ষ্ণতাতে ভর ক’রে ঋতুহীন স্তব্ধতা বেঁধেছে কি ঘর আঁধারের ঘূর্ণিপাকে? হারিয়ে-যাওয়া তালপাতার মাকড়ি অস্ফুট চিৎকারে সংশয়ের বৃত্ত চিরে ঝিনুক-অভ্যাসে ব্যথার ভেষজ মুক্তো বুনতে শুরু করে।
প্রমত্ত অবসরে হঠাৎ আমার হৃদয়কোণে পড়ে-থাকা তোমার একটা কথা চলকে উঠল, ‘উন্নাসিকতা আর ব্যাঙঝাঁপের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা!’ ধাপেধাপে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে এটা সহজেই অনুমেয় হতে পারে, ‘মুড়ির টিন শীর্ষক ভিড়ের বাসে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার চেয়ে বাসন্তী সন্ধ্যায় বারান্দায় ব’সে সিদ্ধ ডিমের সঙ্গে এককাপ লাল চা আর একটি ভিটামিন ডি ট্যাবলেট চিবানো মোটেও উদাসীনতাপ্রসূত বিলাসিতা নয়!’
অয়োময় শহর থেকে দূরে, লতাপাতার প্রথাগত প্রাসাদে সহজাত আন্তিগোনেদের পোশাকি নাম প্রজাপতি। পুষ্টিবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত ছাত্রদের মধ্যে পরিচালিত পাকাপাকি এক-জরিপে দেখা গেছে, ‘কিসের মধ্যে কী, পান্তা ভাতে ঘি’ এই প্রবাদবাক্যটি তাদের সাহিত্যচর্চায় ব্যবহৃত সবচেয়ে আন্তরিক অনুষঙ্গ।
এক-বিঘত জলে কয়েকটি হৃষ্টপুষ্ট ভাতের দানা পৌরাণিক নিমগ্নতায় শ্রান্ত। শাশ্বত দুয়োরানির ষোল-আনা রূপকথা চিরায়ু হয় সামন্তবাদী বিনোদনের উপঢৌকন হিসেবে। সিনেমাহলে-বন্দি প্রবহমান দৃশ্যান্তরে কোজাগরী উটপাখির ডিম বড়ই মনোহর। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে শোভা ছড়ানো ঝটপট পানতুয়ার রেসিপি-বর্ণনায় পোড়া লালমরিচের সহায়ক উল্লেখ কখন অনন্য রসনাবোধের ধারকবাহক হয়ে ওঠে?
মেষদলের মতো মিশমিশে শস্যের গোঠে, সপ্রতিভ পাখা খসলেই বৃষ্টিরা নদী হয়ে যায়। আর নদীও বিরহ-যোগফলে হরহামেশা এক-একটি আয়নাগুচ্ছ।
বুকের গভীর প্রদেশজুড়ে জন্মহীন ইছমতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ জলের চড়কায় দ্বীপান্তরে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে বোনে নিরন্তর। থরেথরে পথ আগলে দাঁড়ায় রঙিন মোহের সুরম্য পাথর। যুক্তিবাদী কচুরি ফুলদের পক্ষাবলম্বন করে আমিও কিছু শ্লোগান লিখে দিলাম অবিসংবাদিত পানকৌড়িদের সৌজন্যে, ‘নদীই গতি,’ ‘নদীহীন জীবন মানে দ্রুতিময় কুরুক্ষেত্র,’ ‘অপুষ্ট নদী প্রলম্বিত আঁধারের আরেক নাম’, ‘নদীই প্রাণের অবিরল প্রসূতি!’
নিশ্চল হাওয়ার দেয়ালে-দেয়ালে শ্লোগানমুখর পোস্টারগুলো সাঁটা হল। বোধের রাজসিক সমুদ্দুর বড়ো ছোঁয়াচে! ঐকান্তিক সজারুর সূক্ষ্ম ভঙ্গিমাতে দেবদারু বনের ওপার থেকে ছুটে এল দুর্দমনীয় ঝড়। স্পষ্টবাদী জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে চুরমার হল হিংসাত্মক বাঁধের সকল ব্যঙ্গাত্মক আগল।
অসফল পরশ্রীকাতরতা উদারতার ঝুলিতে আশ্রয় পেলেই, অমনোযোগী রবিনহুডের দরবার অবধি পৌঁছে যেতে পারে মহিমান্বিত খরগোশের পোশাকে কালসাপের ছোবল! ঘুমভাঙা রঙের শতরঞ্জিতে একটি শামুকফুল হাতবোমার একাগ্রতায় ছড়াতে লাগল লাবণ্যের ছররা। যেন এই ভেবে-ভেবে আকুল, ‘শামুক আর গোলাপ তো দূর-সম্পর্কের চাচাত ভাইবোন। তাহলে প্রতিটি শহর কেন ফিরে যাবে না ফড়িঙদের অভয়ারণ্যে?’ এদিকে মুরুব্বি নাগরদোলার বিহ্বলতা নিয়ে আমার আঙুলগুলো উদ্ভিদজগতের অনভিজ্ঞ সদস্য হতে বাকি। চালতার গায়ে মানচিত্র-মতো আঁকিবুঁকি-পটচিত্র দেখে ভূগোল-বিষয়ক অভয় দীক্ষাটা ঝালিয়ে নিই আনমনে।
কোনো এক-শুভক্ষণের মিত্রাক্ষর আলোড়নে, সৌন্দর্যসচেতন পাতাবাহারের কাছে সমীচীন তরবারি ভিক্ষে চেয়েছিল বর্ণিল কিছু নির্লিপ্ততা। ওসব দেখে তুলসিপাতারা ঘুম বিষয়ে গম্ভীর গতিবিদ্যা অর্জনের সিদ্ধান্ত নিল। ধান-মাড়াইয়ের পর্ব শেষ হলে, ভুবনডাঙা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় খোলা হয়। সুহৃদ চাবির বহুকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়ায় তালারা আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। হঠাৎই দম-ফুরিয়ে-ফেলে এমন একটি ফুটবল পাড়ার অতিত্যাঁদড় ছেলে ঝন্টুকে সারা মাঠজুড়ে নাচাতে লাগল। পুনরায় নির্বাচিত সদ্য চেয়ারম্যান মতিউল্লাহ উল্কাগতিতে হেডমাস্টারের রুমে ঢুকে সালাম ঠুকেই বললেন, ‘স্যার, এবার আমার সর্বাত্মক সম্বর্ধনা-সভায় কিন্তু অনবদ্য পালাগানের আয়োজন করতে হবে। নিন্দুকের মুখে পড়ুক ছাই! সম্পূরক বাজেটের সঙ্গে যোগ করার জন্যে আরো সাঁইত্রিশ হাজার টাকা আমি বেশি অনুদান দিচ্ছি।’
নাদান ভালুকের গাম্ভীর্যতায় গাল ফুলিয়ে এক-তাড়া টাকার নধর বানডিল পড়ে রইল টেবিলের ওপরে। (চলবে…)