পর্ব ০৫।।
কোনো এক-রাসপূর্ণিমার মসৃণ জোছনাতে-দীপান্বিত দিঘিপাড়ে নির্মলা আমাকে খুব একান্তে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বনমালী কি শুধুই প্রখর সূর্যদীপ্ত অপেক্ষার জোছনার্ত প্রতিমা? কিংবা গোলাঘরের মতো নিঃসঙ্গ স্মৃতিকোষে বৃষ্টির ফেলে-যাওয়া ছায়াদের অনন্য সাঁতার?‘
সঅরণ্য, আকাশি বাতাসের স্বরধ্বনি আর বৃষ্টিজ নদীর ব্যঞ্জনধ্বনি একত্রে মিশিয়ে তুমি হয়ত নিতল অগোচরে ঝরাপাতাদের আড়ংকে অবারিত করো। বিষণ্ণ বালুদের ব্যাকুলতা কে কতটা জানে? আবাল্য লাবণ্যের দুর্গে মধুকূপী ঘাস দ্বাদশীর আলোতে আরো প্রগাঢ় হয়েছিল। সোনালি আলোর নহবতখানা থেকে জাফরানি আলোর জলসাতে প্রবেশ করি। কোথাও কি পাহাড়ি ফুলদের সুবাস-তর্পণের পার্বণ চলছে? জোছনার মিহি কুণ্ডলীতে জড়িয়ে যায় লেবুতলার ঘ্রাণ।
আনাচান-করা রজনীগন্ধার শাদাটে জেল্লাতে চকচক করছে রাতের নিস্তব্ধতা।
স্বাধীনতার শতাব্দ-উঠানে মেঘের পায়রারা বড়োই মনোহর। বিস্মৃতিতে-ব্যাধিগ্রস্ত শহরের ঘরদোর আর ঊর্ধ্বশির মরীচিকার নৌকাডুবি-প্রবণতা– এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সম্ভাবনাময় যোগসুত্র খুঁজতে গিয়ে, নগর-উন্নয়নবিদরা মোমের ময়ূরমহল তৈরির পরিকল্পনা করতে লাগলেন।
সুলক্ষণা, আর্কিমিডিসের প্লবতাসূত্রে বশ্যতা স্বীকার-করা কুমির যখন নিজেকে সরল জলের সহজাত চিত্রকল্প ভাবতে শিখেছিল, তখন হাওয়াদের সবুজ পেখম আক্রান্ত হয়েছিল হইচই-ধরনের একাকীত্ববোধে। কপোত-কপোতীদের অভয়ারণ্য বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশ-ঘেঁষে তিরতির করে ছুটে-চলা নদীটি কখনোই বসন্ত বউরি হতে চায় নি। তবে বুকের গভীরে লুকিয়ে-রাখা কিছু মেঘ গত রঙধনু-দিবসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ফানুস হয়েছ তো, আমাকে ভুলে যেও না।’
চুলবুলে ঘুমের উদারতা নিয়ে কলাগাছের একটা আত্মিক ভেলা ভাসতে-ভাসতে আকুলতার দেয়ালে বারবার ঠোক্কর খায়।
অবেলায় বেহুলার হারিয়ে-যাওয়া রুমালেরও আছে রূপকথা বলার অধিকার। যেমন কোরে স্বজাতি বাতিঘরের থাকে সুখদুখের একগুচ্ছ পরাবাস্তবতা।
চন্দ্রবোড়ার ফেলে-যাওয়া তুচ্ছাতিতুচ্ছ ছায়া কখনো কি অন্তর্মুখী জোছনার অবুননযোগ্য অভিমান হয়ে দ্বিধাহীন মৃত্যুফাঁদ পেতে রাখে? আনমনা রাঁধাচূড়া গাছের চিলেকোঠায় কালো বিড়ালের অভিনয়ে ডাঁশা ঝড়ো-হাওয়া এসে বিশ্রাম নিয়েছিল নিঃশব্দে।
মধ্যরাতের অবাধ্য নৈঃশব্দ্য বড়োই ডাকাবুকো। অভিন্ন কিন্নরীদের মগ্নতায় তরল সোনার ঊর্মিল চুলগুলোকে সবুজ ব্যালকনিতে নেড়ে দিল পূর্ণিমা।
অরুণিমাময় কাঞ্চনজঙ্ঘার চৌকাঠে, নিপুণ ঠোঁটের কারুকাজে, মায়ার অক্ষরে, নিজের নাম খোঁদাই করেছিল পথভোলা এক-কাঠঠোকরা। ইয়ারদোস্তও হয়ে গিয়েছিল অন্যরকম কিছু কাঠবেড়ালি। একদিন হঠাৎ স্বাস্থ্যবান-রণতরী-ধরনের দমকা ঝড় তছনছ করে দিল তার দেবতুল্য নীড়।
নিবিড় আতঙ্কের শতমুণ্ডা সর্পিল দানব কি প্রলয়লীলার অনিবার্য অনুচর? এখানে নয় আর। অন্য কোথাও। পুবে। আরো পুবে পাড়ি দেবে সে। যেখানে সূর্য ডুবে যায় নদীর অতলে প্রশান্তিতে-পাগলপারা দিন উপহার দেয়ার স্বর্ণাত্মক প্রতিজ্ঞা নিয়ে।
পলেস্তারা-খসা পৃথিবীতে বিশ্বাস কি শুধুই নিরীক্ষামূলক? একেকটি আত্মবিশ্বাস অবধারিত দুর্গ হয়ে উঠলে, দীপান্বিত স্টেনগান কেবলি দুখী মায়ের অশ্রুসজল আঁখির কষ্টে বারবার মুখরিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধে। বায়ান্ন আর একাত্তর শোণিতে চির-উদ্ধত আমার অস্তিত্বের দু’ দুটো বজ্র-নিশান। ভাইয়ের কবরের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে হৃদয়ে ধ্বনিত হতে থাকে, ‘স্বাধীনতাহীন দেশে আত্মরক্ষার অধিকার ভঙ্গুর কাচের চাকচিক্যমাত্র।’
আমার সম্মান, আমার আন্তরিকতার মাণিক্য, মোকামহীন কোন সে-হায়নার কাছে এত সুস্বাদু? শুধু লুটে নিয়ে চেটেপুটে খেতে চায়!
রোরুদ্যমান চিত্রা হরিণের জামানায়, শোষণের কাপুরুষ-তীরে বিক্ষত হতে-হতে, ভেবে দেখা হয় নাই, ‘ভালোলাগার রাজত্বে এ-আমি প্রকৃত রাজাধিরাজ।‘
পুবে আছি নিজস্ব সীমানায়। বেশ ভালো আছি আমার উচ্ছ্বাসে। পশ্চিমের এতটুকু হটকারী ঝড় আমার কেশাগ্র স্পর্শ করলে, আমার আভিজাত্য কামানের গোলা হয়ে তা দুমড়ে-মুচড়ে দেবে। শীতের হাড়-কাঁপানো হাওয়ার নিষ্ঠুর কারাগারে একচক্ষু দৈত্য আমাকে ছুঁড়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। তাতে কী! দাঁতাল বুটের ঘায়ে লতাপাতারা পিষ্ট হলে, ঘণ্টাধ্বনির সঘন উচ্চারণে অভিসম্পাত বাজবেই, ‘নিপীড়ন, তোমার আত্মার পরমাত্মীয়রা জলহীন কষ্টের ধাতব দেয়ালে মাথা ঠুকে-ঠুকে মাতবে আত্মাহুতির নিদারুণ উৎসবে।’
চিৎকারে-চিৎকারে জানান-দেয়া চড়ুইপাখির চাঞ্চল্য প্রেরণার নক্ষত্রবিন্দু হয়ে মর্মমূলে জেগে আছে। কাশের মশাল মঙ্গল-কামনার একেকটি প্রদীপ্ত প্রদীপ। আমার লালসবুজ-আঁকা স্বাধীনতা আমার প্রাকৃত অভিভাবক।
ভৈরবী কথকতার কত্থক রেশ দোআঁশের পেলবতায় ব্যাকুলতা আনে। বিবর্ণ হতে জানে না অআকখরা। একদিন একটি কাঠগোলাপ বাবা আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘ফুল, সে তো স্বদেশপ্রেমের সার্থক প্রতিশব্দ।’
চেতনালব্ধ তিস্তার সর্বাত্মক তীরে-লীন ভাওয়াইয়ার সুর মুক্তপাখির প্রবণতা দীক্ষা দেয়। পালতোলা-নৌকার সাহসিকতা-সিক্ত এইসব অবিভাজ্য দ্যোতনা স্মৃতির পাঁজরে লেপ্টে থাকে মুক্তির শপথ হয়ে। মুক্তিযুদ্ধ, তুমি তো একটি ফড়িঙের লাবণ্যঘটিত উচ্ছ্বাসের মতোই প্রাণবন্ত ভালবাসা। স্বদেশ? রক্তে-ভেজা ডাইরিতে প্রজাপতি-অক্ষরে লিখে-রাখা শহিদ বোনের প্রান্তিক আত্মকথন!
ভালবাসা কখনো আক্রমণাত্মক হতে পারে না। প্রয়োজন ফুরালে ফেলনা-তৈজসপত্রের মতো ছুঁড়ে ফেলা যায় না প্রেম। ঘূর্ণিপাকের অস্থিরতা নিয়ে তা এসে হঠাৎ মিলিয়েও যায় না।
অবলীলায়, যদি শালিক হও, নদী পেরুতে তোমার সেতুর প্রয়োজন হবে না। আন্তরিকতা সেতুরও অতীত একটি অবাক উছিলা। প্রেমিক, সে তো একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়ার মতোই প্রস্ফুটিত উচ্ছ্বাস। দিগন্তের ব্যাপকতা নিয়ে নিয়ত খরস্রোতা বিশ্বাস। কিছুতেই যে দমবার পাত্র নয়!
একমাত্র ভালোবাসলেই, কেউ বোঝে সে বেঁচে আছে। যেভাবে ঢেউ নীল নদের বুকে এঁকে দেয় বয়ে চলার প্রেরণা।
বুকের গভীর প্রদেশজুড়ে জন্মহীন ইছামতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ জলের চড়কায় ধূ ধূ দ্বীপান্তরে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে বোনে নিরন্তর। স্ট্রবেরি-ক্ষেতের পাশ ঘেঁষে, ভালোলাগারা থরেথরে পথ আগলে দাঁড়াল রঙিন মোহের সুরম্য পাথর হয়ে।
পথভ্রষ্ট অচেনা সোঁদা-গন্ধ বিক্ষিপ্ত শিহরণে নীলকান্ত মণির মতো চিত্রল হরিণীর ভালোলাগা দেবে কি সারাবেলা! সারাবেলা!
নেপথ্যে বেজে-ওঠা সন্দেহাতীত খড়কুটোদের মলিন হুল্লোড় কুড়িয়ে নিয়েছে বাউড়ি বাতাস। কোথাও একমনে হেঁটে-চলা, মহাবাউলের আত্মভোলা ছায়ার পিছু-নেয়া, প্রগাঢ় পাখিগুলো কেমন আছে? তাদের নিদাঘ কিচিরমিচির কেবলি থেকে-থেকে কাকতাড়ুয়ার পকেটে উবে যায়।
দূরত্বের পর্দা চিরে, বিপরীত বাতাসে ভেসে এল দৃশ্যহীন নানা ফুলের নৈঃশব্দ্যমূলক সুবাস।
শুধু নিঃসঙ্গ পড়ে থাকল বিহ্বল নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জোছনার্ত রাত-কাটানোর একটি চিত্রল ইচ্ছে। (চলবে…)
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন