পর্ব ০৪।।
যথেচ্ছা ঘাসের কাতারবদ্ধ শিশিরের শিহরণে-হারানো বাদশাহি-সিলমোহরযুক্ত হীরের আংটি জানে, বিনা-নোটিশে স্বেচ্ছানির্বাসন কত-না রোমাঞ্চকর হতে পারে!
মঞ্চ-অভিনেতার অকিঞ্চিৎকর রাজ-উপাধিকে অবজ্ঞা কোরে, কান্নার ধ্বংসস্তূপকে যার-পর-নাই এড়িয়ে, অবশেষে এখানে এলে। কে তোমাকে পরাবে রাজতিলক? তাকে বলে দিতে পারো, ‘তরল-আয়নাতে কেন্দ্রীভূত অন্তিম প্লবতা কখনো-কখনো আকাশের নিচে জমাটবদ্ধ নদীর প্লাবনজনিত আলাপচারিতা নয়। উৎসর্গহীন তেমন স্বর্গে গঙ্গাফড়িঙ ডানা থেকে ঝেড়ে ফেলে একেকটি শাহানামামূলক দুপুর।’
শঙ্খচূড়সুচক হেমলকের বিষ পান করার সাহসিকতাপূর্ণ বীরপুরুষ আমি নই। অতএব আমাকে সক্রেটিস বলে চিহ্নিত করো না। একটি পরিণামদর্শী লালমোরগের মতো অপরিশোধ্য ঋণ আন্তরিকতার আদলে কোথাও ঘাসফুল হয়ে ফুটে আছে। অনার্য প্রস্থানের ভ্রাম্যমাণ ভাস্কর্য অলক্ষ্যে ফেলে যায় তার আলোকিত ছায়াগুলোকে কোনো অর্থহীন খড়কুটোকে উত্তরাধিকারী কোরে?
নুপূরের মর্মার্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঝরাপাতারা-যে বৃন্দাবনী রাগে কথা বলতে অভ্যস্ত, তা তারা গুঞ্জনপ্রিয় দখিনা হাওয়াকে বোঝাল। শুভ জন্মদিন কি সদ্য তীরে-ফেরা জাহাজের অলস-অলস ফানুস ওড়ানোর নিরলস অভিলাস? কিংবা আঁজলাতে পুষে-রাখা অবসরের বেলুনসুল্ভ স্বার্থপরতা? আবাবিলসূত্রে বোখারা-থেকে-আগত মেঘদের ফাগুন-বিলাসিতা? তোতলা বৃষ্টিরা উতলা রিমঝিম শব্দে পারাবত হয়ে ডানা মেললে, উন্নাসিক ঝাউগাছ আদর্শ ঋষির অনুলিপি হোয়ে ধ্যানে মগ্ন বর্ণিল হাওয়ার অভয়ারণ্যে। এবং আসন্ন বেলাগুলোর পক্ষপাতিত্বে ক্ষণজন্মা লাবণ্যরা একে অপরের প্রতি শুভেচ্ছা বিনিময় কোরে বলতে লাগল, ‘ভালো থেকো পৃথিবীর সকল ভালোলাগা!’
অভাগা এই আমি কি কয়লাখনি-বিশেষজ্ঞ? কিরণমালা, সূর্য-অস্পৃশ্য হওয়ার মতো অভিশপ্ত জীবন কে আগলে রাখে দু’ হাতের তালুতে নির্জন বধিরতায়? কানাগলির মোড়ে দালানবাড়ির ভূগর্ভস্থ চিত্রশালাতে চড়ুইভাতি-ধরনের ধারাবাহিক পাথরজন্ম যাপন করি ক্ষণে-ক্ষণে। কোথাও কাকাডু রঙে-আঁকা ডুমুরের ডাল বাতাবি-শৈবাল হয়ে অখণ্ড বাতাসে দুলছিল।
দোর্দণ্ড ভুলো মন। তাই ভুলে যাই– সিঁদুর-পরিহিত হয়েও, চিত্রল আলতামিরার মতো রমণীয় কিছু মেঘ কেন বৃষ্টি হতে শেখি নি!
চিরাচরিত সকল বেলা অন্তর্দৃষ্টিহীন নয়। সে-কথা না-হয় তোলাই থাক। বৈকাল হ্রদ থেকে পালতোলা আলোছায়ার ঝাড়বাতিগুলো ছলকে পড়ে জন্মান্তরে।
মতান্তরে, বয়সী চুম্বন হোয়ে চাতকী-সঙ্কোচ আড়াল নিল কি পদ্মপাতার সন্তরণে? বৈতালিক বিকেলে নীল সিফনের শাড়ি-পরা অনামিকা ঋতুর নরম ছোঁয়া শর্তহীন শ্রাবণকে কামনার্ত করে তুলেছিল।
তুমি বলেছিলে, ‘সরলরৈখিক সম্পর্কে-প্রেমার্দ্র সাজঘর চিরকাল সাগরসাশ্রয়ী। গতানুগতিক সকল ফুল গোলাপ নয়। কিন্তু সকল গোলাপ অন্য ফুলদের মতো একই ভাষায় ভালবাসার কথা বলে। ভালবাসার ময়ূরতান্ত্রিক বাগানে ফুল না-ফুটলে, বুঝবে কোথাও ভুল হয়েছে। সে-ভুলের মাসুল দৈর্ঘ্য-প্রস্থে নেকড়েচিৎকারে-খচিত রাতের মতোই প্রলম্বিত।‘
জাতপাত নেই, দুর্বিনীত সে-রকম দুর্ভাগ্যও ক্রমশ সৌভাগ্যের অবৈতনিক অনুগামী। যুদ্ধ ও শান্তিতে পিএইচডি ডিগ্রি-করা মেজর যখন রাজপথে ভুখামিছিল অবদমন করার জন্যে নৃশংস কারফিউ প্রয়োগে ব্যস্ত, তখন অলিখিত ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা-চাড়া দিয়ে একটি লাল টিউলিপের অস্তিত্ব জানাবার সময় ঘনিয়ে আসে।
তালিকাবিহীন চৌরাস্তার আশেপাশে পড়ে-থাকা ভাঙা বেহালাতে প্রতিবাদের টঙ্কার বেজে উঠেছে কি ভাষার দাবিতে হারিয়ে-যাওয়া ভাইদের আকাশি ব্যাকুলতা হয়ে?
হিংস্রতার নিরেট আশঙ্কা যশোর রোড ধোরে এঁকে দিয়েছিল দুর্বৃত্তায়নের পদচারণা। সময় বুঝি কখনোসখনো কালো বেড়ালের সাজ নিতে পছন্দ করে ডহর রাতের আনকোরা অন্ধকারে?
হাল ভেঙে গেলেও, নদীর দেশের মাঝি জানে কীভাবে নৌকা তাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। আর প্রতিটি মৃদঙ্গ মোরগ ঠিকঠিক ডেকে আনে একেকটি আশালতার দিন।
যে-দেশে সোমেশ্বরীর মতো আথালিপাথালি জোছনা মহুয়া, মলুয়া, কাজলরেখার গল্পে স্নাত, সে-দেশের সোনার ছেলেরা বিপন্ন মায়ের সম্মান রক্ষার্থে অবলীলায় হৃদয়ঙ্গম করে– কী কোরে দৃঢ় চিত্তে রাইফেল ধরতে হয়; কী কোরে ছুঁড়তে হয় প্রতিশোধের গ্রেনেড হায়নাদের পদমূল চুরমার করে দিতে।
আজো বাতাসি আকাশে ওড়ে কচি পেঁয়াজপাতার উদ্দীপনাতে-রঙিন পায়রার বর্গীয় পাখসাট।
এন্তার জানিয়ে রাখি, একটি গুলিবিদ্ধ ধানশালিকের বদলা হিসেবে দশটি দানব শত্রুর মৃতদেহ অতিতুচ্ছ! অতিনগন্য! রেসকোর্স ময়দানের প্রতিটি ধূলিকণা বুঝেছিল– অভূতপূর্ব স্বকীয়তায়, কেমন কোরে আত্মবিশ্বাসকে উচ্চশিরে দাঁড়াতে দিতে হয়।
পাখির চিরায়িত চিৎকারে নদীর ঘুম ভাঙে। রূপালি সারা শরীরে অবারিত পুবালি ঢেউ কোন সে-মায়াময়ী বিছিয়ে দেয়? নায়ের ছোট্ট ছইয়ের ভেতরে পাঁচটি কিশোরের ঊর্ধ্বশ্বাস-প্রতীক্ষা তীক্ষ্ণ তলোয়ারের আবেগে উদ্দীপ্ত করছে হাতে-ধরা স্বর্গীয় আগ্নেয়াস্ত্রগুলোকে। ও-পাড়ে দাঁতাল জিপের আসন্ন হুংকার রোধ করতে গর্জে উঠবে নীরব বন্দুকের মুখরতা।
সরব পেলবতাতে উদ্বুদ্ধ পানপাতার হৃদয়ে প্রকৃতি যতটুকু বিন্দুবিন্দু শুভাকাঙ্ক্ষা জমা রাখে, ততটুকু ভালবাসা দিয়ে নিরালাকে কাছে পেতে চেয়েছিলাম।
অতিক্রান্ত তৃণভূমির সীমান্তে হীরের-টুকরো মৌমাছিদের অভিবাদন ঘনীভূত হলেই, বসন্ত ঝোপঝাড়ের গায়ে ফুলেল গর্জন মেখে দেয় সঘন। যেন বলতে চায়, ‘সাহসী হৃদয়ের কৈশোর আর সহিষ্ণু ভালোলাগার যৌবন কখনো ফুরাতে পারে না। একেকটি প্রার্থনাময় গোধূলি আসে তো আরেকটি সোনালি সকালকে আবাহন করতে।’
পিচ্ছিল আঁধারের সঙ্গে লড়তে-লড়তে, চিরন্তন বনানী ছুঁয়ে সূর্য উঠলেই, অপূর্ব মোহমুগ্ধতা মনন ছাপিয়ে লাল-সবুজ পতাকার প্রশান্তি বিলায়। কিংবা জীবনানন্দের এক-অবিস্মরণীয় ধানসিঁড়ি কোথাও সুদূরপুরের দেহলিতে কুলকুল বেগে বয়ে চলেছে থেকে-থেকে।
কে আমাকে শোনাবে নেকড়েহীন রূপসী বাংলার পবিত্র রূপকথা অবিরল? (চলবে…)
অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন