জলধি / কবিতা / ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা শূন্যতা এক-কালোজাদুকর
Share:
ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা শূন্যতা এক-কালোজাদুকর
পর্ব ০৩।।    

কোনো সুলোচনার আঁখিতে-রাখা উদ্বৃত্ত মায়া শুকতারা চেয়ে নিয়ে হয়েছে আরো নিতল?

হতচ্ছাড়া হাওয়ার দঙ্গল তালপাতার বাঁশিতে পড়ে-থাকা নিঃসঙ্গ সুরকে একলহমায় কেড়ে নিল।

ধনেশ কি ডেকেছিল টলটলে আয়নার ঈশান কোণে?

তোমার অনিমেষ মুগ্ধতা জলমহালের চৌহদ্দি পেরিয়ে একেকটি জালালি কবুতর হয়ে কোন পাথারে উড়াল দেয়? অজান্তে এই আমাকে অসামান্য ছুঁয়ে যাও থেকে-থেকে। আর ছুঁইছুঁই কোরে, তোমাকে আমার ছোঁয়া হয় না অপূর্ব এক-দ্বিধায়। এভাবে স্পষ্ট বুঝে যাই, তোমার চোখের অতলে নিবিষ্ট আমার যথার্থ আসা-যাওয়া।

লালিমা-ছাওয়া প্রাথমিক পাখিরা দিগন্তে মুছে গেলে, হৃষ্টপুষ্ট পাটপাতার অহমিকাপ্রসূত পাঁজর চুয়ে একেকটি ঋতুর মিমিক্রি উছলে পড়ে ঋজু শিশিরের ছদ্মবেশে। সারাবেলা চারণভূমিতে প্রস্তুতিহীন ঘুরেঘুরে, দৃশ্যহীন একটি নীলগাই ভুল কোরে রেখে আসি দীর্ঘতম রাত্রির মসৃণ উপত্যকায়। একপেশে স্কুল-দালানের পাশঘেঁষে বেড়ে-ওঠা অপাপবিদ্ধ পেঁপেগাছটার শেখা হল না ক্লাশ-পালানো ছেলেদের ঐকান্তিক ফুর্তিবাজি।

নৈরাশ্যে গররাজি বিভীষণের বিদগ্ধতা চঞ্চল উলে-বোনা ব্যাকুলতার উল্কাকে বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের বিনম্রতা দিয়েছিল।

শেষ-বৃষ্টিবিন্দুটির তৈলচিত্রে-অন্তর্গত পাটলরাতে পুবাকাশি মেঘদের ঋতুবদলে উল্লেখ ছিল, ‘মোহের মসনদ শূন্যতার চোখ-ধাঁধানো দখলদারিত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। অমন জন্মান্ধ পৃথিবীর সন্ধ্যাতুর অধিকার ছাড়ো। পূর্ণতার সিংহদ্বারে এসো। পুণ্যতোয়া নদীর তীরে স্বেচ্ছায় যে বেঁধেছে ঘর, সে-ই সাগরময় পূর্ণতার স্বচ্ছ সন্ধান পেয়েছে।’ 

জনমদুখীর আংটিতে রক্তমুখী নীলার ডাগর রোশনাই বাসনাওলা-সাবানের মতোই পিচ্ছিল। চিত্রল হরিণের ঘুম কে নেয় কুড়িয়ে ঝরাপাতাদের আশ্রয় থেকে? 

সূর্যোদয়-আঁকা শেরপা-পাড়াটা ডানে রেখে, সুচারু মৌমাছিরা চিতাবাঘেরর ব্যগ্রতা নিয়ে কাঠগোলাপের গিরিখাতে রুটিরুজির প্রকৃত তাগিদে আত্মাহুতিতে মেতে উঠেছিল। পাথুরে মানবতার পৃথিবীতে পাথর থেকে পুনরায় মানুষ বানানোর মন্ত্র-জানা ডাইনিবুড়ি বুঝি একটিও নেই বেঁচে? তেমন মায়াবিনীর খোঁজে পাহাড়ের শীর্ষদেশ থেকে গড়িয়ে পড়ে অঝোর ঝোরার অংশীদারহীন ক্ষরণ। 

উজবুক উটের অগণন অর্থহীনতা খুঁজে-বেড়ানোতে কাতর শেয়ালের কখনোই বিশ্বভ্রমণে যাওয়া হয় না। স্বপ্নকূপে ডুবে তন্ময় হয়ে ভাবতে থাকে, ‘নিমেষে এই অমানবিক দুনিয়াটা শুধুমাত্র বনমোরগদের দখলে চলে যাক!’

তাহলে, অবাধ সাঁওতাল সর্দারের মতো সে-বনে কি ঘুরে বেড়াবে-না ঈগল, বাজ, শেখ ফরিদ? 

এক-মনসাসঙ্গীত দূরত্বে জেগে থাকে আসমুদ্র-হিমাচল পূর্ণিমার নৈঃশব্দ্যবিদ চাঁদ।

হার্মাদ মগ্নতার থিকথিকে মোড়কে লুকিয়ে-রাখা স্বর্ণমুদ্রার অসম লাবণ্য কখনোই জোছনার্ত ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারে না। চটুল তেঁতুলপাতার লোকাতীত কাঠগড়াতে দাঁড়িয়ে গোলন্দাজ দুপুর প্রাচীন ঔষধালয়ের নিমগ্নতা নিয়ে একটি বৃষ্টিস্নাত বেলার যৌক্তিকতা আওড়াতে থাকে। কোথাও ‘চিচিং ফাঁক’ ধ্বনিত-মন্ত্রে খুলে গেল সন্দেহদগ্ধ গুপ্তধনের ঘুমঘুম গুহা। সেলুনে চুল কাটতে ব’সে, চল্লিশ চোরের যখন অতর্কিত চা-তৃষ্ণা পেল, তখন ভারপ্রাপ্ত মরজিনা কি শহরের শেষ-বাড়িটার আঙিনায় সাংকেতিক আলপনা আঁকতে ব্যস্ত? 

কখনো বঙ্গোপসাগরের অবিন্যস্ত ঝড়ে বিধ্বস্ত সিন্দাবাদের নৌকো টেকনাফ এসেছিল? সর্বস্ব-হারানো নাবিকরা কি সেই জাহাজে করে তারাফুলের অনিন্দ্য বৃক্ষ শিউলির চারা নিয়ে গিয়েছিল আরবদেশে?

আহা, শৈশবমুখী বর্ষামুখর দিনে উৎসবপ্রিয়-বর্ষাতি মাথায় বান্ধবীর গায়ে-হলুদ অনুষ্ঠানে এসেই তুমি বুঝলে ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছ। 

নির্বিশেষে, গনগনে ছাতার নিরুদ্দেশ মরদেহ থেকে খসে-পড়া ছায়ার ব্যাঙ ট্রামে চেপে ঘুরতে বেরোয় ঝড়বাদলের জনশূন্য শহরে-শহরে। তারপর একসময় ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে দোআঁশ দালানকোঠার প্রতিটি সিঁড়ির অতি-আনাচেকোনাচে লুকিয়ে পড়বে কি?

জগতি, আমাকে নিয়ে কেন শুধুশুধু করো ছেলেখেলা? কেবলি কেড়ে নাও আমার বেলা-অবেলাগুলো আনচান-করা জাহ্নবী-দাপটে।

কথার কথা! লজ্জাবতী চোরাটান কি চিরকালই অমরাবতী?

কে জানে, কালাকালের বাইরে মুখপোড়া নির্জনতা অগোচরে ময়ূরপঙ্খি নায়ের অনুকরণে আমাকে দিয়েছিল সামুদ্রিক আস্থার রূপবতী গৃহস্থালি!

আথালিপাথালি বাদাবনে দোর্দণ্ড গুণিনের ভঙ্গিমায় সুখ্যাত কামরাঙাগাছ আনুমানিক দুপুরে একলা দাঁড়িয়ে। বেগতিক বাতাসকে পরাধীন রেখে নিজের আত্মবিশ্বাস জাহির করছে। ঘাড়ের দু’ দিকে ঝুঁকে-পড়া ঝাঁকড়া ডালপালাতে তাকে মাঝেমধ্যে রবিনহুড-রবিনহুড লাগে। অথবা, নিজেকে কখনো-কখনো কঠিন হৃদয়ের পাপাত্মা ভাবে। একবার এক-মুসাফির হলদেপাখি পথ হারিয়ে তার নিবিড়াকীর্ণ পাতার ঝোপে দু’ দিনের আশ্রয় চেয়েছিল। তখন বিশৃঙ্খল কিছু হাওয়াকে ঔপনিবেশিক কায়দায় দখলে এনে মাঙ্গলিক কামরাঙাগাছ আকাশে ওড়াচ্ছিল তার অবিরল চুল। হলদেপাখির প্রতি তেমন ভ্রুক্ষেপ করার সময় কোথায়?

দেবদারুময় আন্তরিকতার উনিশতম রজতজয়ন্তীতে, পেনিলোপরূপী বৃষ্টির ছোপছোপ স্ফুলিঙ্গ সূক্ষ্ম পোড়াদাগ এঁকে দেয় উজান থেকে ভাটিতে। ভাটি থেকে উজানে। বৈঠাবিহীন নৌকা দিয়েছিলে। ভাগ্যাহত ফলবিক্রেতার মতো সদাগর হয়ে বাণিজ্যে যাওয়া হল না। মাছ-শিকারের জন্যে প্রত্যক্ষ-মাছরাঙাকে পোষ-মানানোর কায়দাকানুন আজকাল ভাঙা-হাটে দারুণ চড়াদামে বিক্রি হচ্ছে। বহুলাংশে তক্ষক হয়ে, বুকচাপা বিরহে চতুর্দশীর আঁধারে খুঁজে ফিরি নিতাই ডোমের বাড়ি। ওর কাছে জেনে নেব কৌশলগত নির্লিপ্ততার অসমাপ্ত পাঠ। আসলে, অন্তিম পরশ্রীকাতরতার শশ্মানে সবসময়ই মোতায়েন থাকে এক-মহাজাগতিক নিমগাছ।

কাচ-কাটা হীরের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে এখনো কিছু স্মৃতি চকলেটের রঙিন বাক্স হয়ে হৃদয়ে জেগে আছে। মধুমালতী, আজো মনে পড়ে, তোমার কাছ থেকে কিছু হৈমন্তিক তারা চেয়ে নিয়েছিলাম। নির্ঘুম রাতে ওই তারাগুলকে গুণেগুণে রাখি; পাছে যদি পৌনঃপুনিক অবহেলায় হারিয়ে ফেলি! 

বেলিফুলের সৌন্দর্যসচেতনতা সমুদ্রগামী জাহাজের মতো আমাকে রোদে-সাঁতলানো মেঘের পয়মন্ত পাখাসাট উপহার দেয়। এত যে পাখি হও, আমার ঠিকানাটা শুধু ভুলে যাও। এত যে নৌকা বনানো শিখলাম, তোমার উঠোনটা চেনা হল না। এত যে জল খেলা করে সরল আলোর ভেতরে, কেউ তো মায়াবী-মায়াবী দৃষ্টি মেলে বলল না, ‘আমার চোখের দিকে তাকাও।’

আমার বুকের নদীটাও একটি অরণ্যের অন্তরালে হারিয়ে যেতে চায়। ওতে ক্ষণেক্ষণে ভাসিয়ে দিই আমাকে দিয়ে-যাওয়া তোমার পাঁচটি কাগজের নৌকো। একেকটি দেশ হয়ে নৌকোগুলো আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি খেলে।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান