জলধি / কবিতা / ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা শূন্যতা এক-কালোজাদুকর
Share:
ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা শূন্যতা এক-কালোজাদুকর
পর্ব ০২।।     

নিয়তিহীন ভিখেরি আর থুত্থুরে থালার মধ্যে যেমন মানানসই ভাব, তেমন সম্পর্ক অনেকে খুঁজে-খুঁজে হয়রান কোঁকড়ানো রাতে পোড়াদাগ-আঁকা চাঁদের সঙ্গে থিকথিকে পীত আকাশের।   

ঢের অধৈর্য দলিললেখকদের সবসময়ই মনে হয়, অচিরে তারা চাঁদের সম্ভ্রান্ত বুড়ির পাকাপাকি আতিথ্য গ্রহণ করতে যাচ্ছে। চাঁদের বুড়ির কিছু প্রতিভাধর দলিললেখক দরকার। যে-কোনো সময়ই ডাক পড়তে পারে তাদের বেশুমার জমির নতুন দলিলদস্তাবেজ তৈরির জন্যে।

অরণ্যে পাহাড়ের আতপ সমতলে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েটি চুপিচুপি বুনেছিল আশালতার বীজ। নির্ভেজাল সুনামি কি ওখানেও বাড়াত তার লম্বা হাত?

অভিজাত তুষারবলের অজুহাতহীন ভ্রাতাভগ্নীরা ‘যেমন-খুশি তেমন-সাজো’ প্রতিযোগিতায় সবসময় ক্যাঙ্গারুর বেশ নিতে ভালবাসে। যেমন, লুপ্তপ্রায় আইসক্রিম-প্রীতি অচল ঘুমের একমাত্র উত্তর হতে পারে না। কখনো পরাশক্তির আধিপত্য নিয়ে দর্শনার্থী সেজে, বৈশ্বিক উষ্ণতা পিঁপড়েদের সুস্বাদু দোরে হুমকির জলছাপ এঁকে দেয়। গন্ধবণিক সুগন্ধি কাঠের জন্মদাগ সাজিয়ে রাখে তার পরিচ্ছন্ন শখের নিদাঘ বৈঠকখানায়। গোলাপজামের গায়ে জমে-থাকা শিশিরের অন্তরঙ্গ ঘাম শুষে নিয়েছিল ইটভাটার জেদি ধোঁয়া।  

নাম রেখেছি তার পুণ্যতোয়া। সেই নীলকণ্ঠী পাখিটার ডিম ফুটে মেঘের মতো তুলতুলে কী মায়াবী ছানা হল! আর আমি তোমাকে নিয়ে একটি অকৃত্রিম কবিতা লিখতে পারব না?

ঝিম-ধরা লম্বাটে মেঘ বৃত্তাকারে সূর্যকে ঘিরে ফেললে, সৌবলী নদীর ঘাটে বসে থাকি একটি ময়ূরপঙ্খি নায়ের আকাঙ্ক্ষায়। অসমভূজি ছায়াদেরকে উপাসনালয় ভেবে, অস্পৃশ্য আলোরা আনাগোনা বাড়িয়ে দেয়। উড়নচণ্ডী হাওয়ার দাপটে ধুলোরা ফতুর হল। ভাবে, নিশিথসূর্যের দেশে পাড়ি জমাবে।

এক-সারি বটপাতার সমান একটুকরো আলো আমার মুখে তৃপ্তিহীন আঁকিবুঁকি কাটছে। এখনো কি কোনো বিদুর মেওয়া-বিক্রতা রোদ্দুরঘটিত শিক্ষার্থী ইবনে সিনার পথ চেয়ে থাকে? হিজলতলা থেকে সুপুরিবাগানের দিকে পা বাড়াতেই নিরঙ্কুশ কয়েকটি শালিক আমার দিকে কেমন হেয়ালি আবেশে তাকিয়ে রইল। গুণী গৃহস্থের সপ্রতিভ গাম্ভীর্য ওদেরকে করেছে এই ফাগুনছড়ানো মাঠের অধিরাজ।

আজ একটিও হলদেটে পাখি দেখতে না-পাওয়ার ঢাউস কষ্টের স্তূপকে মাথা থেকে সরিয়ে ফেলি পাতার বাঁশি বাজাতে-বাজাতে। আর অমনি অলৌকিক বকুলগন্ধ আমার কানে-কানে বলতে লাগল, ‘তুমি চাইলেই একেকটি কলাপাতাকে ধানসিঁড়ি বলে ডাকতে পারো।’

ঝিরিঝিরি বাতাস বইছিল করতোয়া নদীর মন্দাক্রান্তা ছন্দে। কনকলতার নিঃশব্দ ঝটিকা উপস্থিতি আমাকে সবসময়ই যার-পর-নাই চমকে দেয়। তেরঙা আঁচলে পূর্ণিমার মতো গোলগাল মুখের ঘাম মুছতে-মুছতে জানাল, ‘তোমার দেখা-স্বপ্ন যদি কখনো গুলমোহরের মতো রঙিন হয়, তাহলে তা একদিন না-একদিন সত্যি হবেই!’

এক-রত্তি বিরহের মৌলিক কাঠঠোকরা নীলকান্ত মণির আর্দ্রতা ছড়িয়ে আত্মিক ত্রিভুজে চালুনির জাফরি-কাটা আলপনা আঁকে। কাঠবিড়ালির চঞ্চলতা নিয়ে চলকে উঠল কি একটি লালশাড়ির ঊর্মিল রসায়ন? মোহের দামামাতে বধির হতেহতে বিগত ঘণ্টার উঠোন ছেড়ে দুপুরের কূপ থেকে তুলে আনি অপরাজিতার মতো নীল পাঁচ-পাঁচটি দ্রৌপদী পদ্ম। সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠির যে-জাদুমায়া রাজকুমারীকে রাক্ষসের ডেরায় ঘুম পাড়িয়ে রাখে, তেমন বিহ্বলতা দেখি ঝরনাতে ভেসে-যাওয়া নিরাভরণ ফুলদের আত্মপ্রকাশে। বিজু-উৎসবের অনুকরণে কে ওই বনবালা অবারিত জলের ভক্ত ক্ষেত্রফলে সাজায় জমকালো একাকীত্ব-তর্পণ প্রতিদিন। 

জন্মবৃত্তান্তহীন স্বপ্নে-অনুরক্ত সূত্র আমাকে স্বেচ্ছাসেবক রাজার মতো ভাবাতে ভীষণ তৎপর। যে-রাষ্ট্রে সবাই রাতকানা, সেখানে রাতে দরজাজানালা খুলে ঘুমানোই রেওয়াজ। চোর-ডাকাতরা তো মধ্যবয়সী দিনের আলোতে তাদের অনবদ্য পেশাগত দক্ষতা দেখাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

সদ্য কলেজ-পড়ুয়া ছেলের ঠোঁটে ফুটে-ওঠা সিগারেটের প্রলম্বিত ধোঁয়া কি রোগশোকে আচ্ছন্ন হাসপাতালের মুখ নয়? ছাপাখানার আঁতুড়ঘর থেকে আসন্ন কোনো পোস্টারের আধখানা অক্ষর চুরি গেলেও, জীবনমুখী মিছিলের বড়ো যায় আসে। কবির হৃদয়ে ফুটে-থাকা একেকটি চামেলি শিউলি কলাবতী যেন পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা অনাগত কবিতার প্রস্ফুটিত প্রচ্ছদ।

নির্জনতার একান্নবর্তী সংসদ-অধিবেশনে, বিষণ্ণতারা কণ্ঠভোটে কুয়াশাযাপনের বিল পাশ করে। একটি ভালো কবিতা লিখতে না-পারার টগবগে অস্বস্তি সমূলে কুড়িয়ে নিয়ে যাক সহায় সম্বলহীন ডাইনিবুড়ির সিপাহসালার মূর্তিমান মরীচিকারা। দলছুট মশা ঝড়ো দানবের নাকে অতর্কিত প্রবেশ ক’রে তার মস্তিষ্কে আঁকুক ঘূর্ণিপাক। থেমে যাক পৃথিবীর নরমুণ্ড-প্রত্যাশী সকল তাণ্ডবলীলা।

তক্ষশীলার কয়েকটি ঋষিজ স্মারক সারস-মানসে পৃথিবী-প্রদক্ষিণে বেরুল কি? আলুলায়িত শীত কিংবা দুপুরে-আসক্ত লকলকে তুষারপাত টিউলিপ গাছের গুঁড়িতে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে। অন্ততপক্ষে বর্ণনাতীত কোনো পিশাচিনির অভিশাপে শ্রোডিঙ্গারের দ্বিত্ব বিড়াল হয়ে তারা চিরায়ু গ্রীষ্মের বেলাগুলোতে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াক অবিরল। দিগন্তের লালাতে-আর্দ্র সন্ধ্যা নেমে এলে, অমন অমোচনীয় বিড়াল ফিরে যাক মায়াময় রাতের লোলিত কৃষ্ণগহ্বরে সূর্যাস্তের ধীর লয়ে লক্ষ্মীপেঁচার সন্ন্যাসে অবলুপ্ত হয়ে।

প্রার্থনার মফস্বলে, সুপ্ত-উঠোনে ছড়ানো মায়াবাদী পায়রাদের নহবত। চন্দনা, চাঁদও কি তোমার লাবণ্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে ঈর্ষাকাতর হয়? পাতিহাঁসের বাধ্যবাধকতায় তরল রুপোর বাতাসে দুলতে থাকে কাশফুলের মশাল। পাশ ফিরে শুয়ে-থাকা ঝরাপাতারাও জানে, আশ্বিনের স্রোতে ভেসে-ভেসে কীভাবে দেখে নিতে হয় রূপসী বাংলার অপরূপ রূপ। কাকের অভিনয়ে পারদর্শী কোকিল কখনো বোঝে না আত্মবিশ্বাস মানে অর্ধেক পৃথিবীর রাজত্ব। আর দায়ভাগ? সে তো ঘোড়ার পিঠে আসীন কোনো যুদ্ধজয়ের চন্দ্রাহত ঘোষণা!

অসংযত নষ্টভাগ্য পিতৃমাতৃহীন কাঁটাতারের দাঁতাল আন্তরিকতা। পচনে-পচনে ঝরে যাক দিকভ্রান্তির সৌজন্যবোধ। আলেকজান্ডারের বিশ্বজয় কোনো প্রান্তিক পরমাত্মার প্রণোদনা? বিশীর্ণ আলিঙ্গনে বেঁচে থাকে না ভালবাসারা! নীল মাছিদের অধঃপতন দেখতে চায় নি নীল তারার গান। তাই তো ওরা আজো অনাবিল আলো জ্বেলে আঁধার দ্রবীভূত করে। অথই স্বর্গ বেচাকেনা করেছে জোনাকির রূপ ধরে। নিঃস্বার্থ রইরাতা পাখির আন্তরিক অভিবাদনে ধুলির আস্তরণে হারানো কানাকড়ি আর পারা-ওঠা আয়নারা একদিন ঠিক অসহায়ত্ব থেকে সেরে উঠবে।

আগরবাতির সুগন্ধ নেড়েচেড়ে, বাতাসের গতিবিধি মাপা যায়? ঈর্ষার রেলগাড়ি অকালে মৃত্যুগামী প্রতিবেশী। বিরতিহীন পরাঙ্মুখতা ওদের গভীর পরিজন। যুযুৎসু কাকতাড়ুয়াদের স্বদেশ পরিভ্রমণে থাকি। ওরা বলে, ‘কখনো রাজা হয়ো না। রাজা হলে মননশীলতার প্রভুত্ব তোমাকে হারাবে।’

কী মনে করে সে-দিন বিদ্যাপতির পরিভাষায় সোমাকে লিখে বসলাম একটি প্রেমপত্র। উত্তরে সে লিখল, ‘আনারকলি শুধু কবিতার পঙক্তিতে যতিচিহ্ন হয়েই বেঁচে থাকে। রঙিন আলোতে ঝলসানো বিবিধ দেয়াল যৌবনের প্রহরী না-হোক। কারণ, বাচাল মগজে যুদ্ধজয়ের দামামা বাজে না।‘

কাজে-অকাজে আর দখিন পাড়ার দিকে যাই না। বড়ো রাস্তার ধারে নশ্বর দেব-দেবীরা অক্ষয় শমপাপড়ি ফেরি ক’রে ফিরছে। চকচকে রাংতা কাগজ দিয়ে ডজনখানেক যমজ রৌপ্যমুদ্রা বানালাম। তারপর লাল-নীল বেলুন কিনতে কিছুদিনের জন্যে বেরিয়ে পড়লাম একটি অভূতপূর্ব অভয়ারণ্যের দিকে। (চলবে…)



অলংকরণঃ তাইফ আদনান