জলধি / কবিতা / তানভীর সিকদারের তিনটি কবিতা
Share:
তানভীর সিকদারের তিনটি কবিতা
নিয়তি
গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্র পড়তে পড়তে
প্রথমবার মন পিছলে আমি
পড়ে গিয়েছিলাম তোমার প্রেমে!
 
কোনো এক অদ্ভুত মোহাচ্ছন্ন জাদুতে
আমার কল্পনায় ধীরে ধীরে তুমি হয়ে উঠলে
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির সেই মোনালিসা।
 
পড়তে বসলেই —
পদার্থবিজ্ঞানের গতিবিদ্যা চ্যাপ্টারে ছাপার কালিতে বন্দি যাপন করা হরফগুলো জড়ো হয়ে
এঁকে দেখাতো উপমাবিহীন তোমার দু'টি চোখ!
বস্তুর গতি কিংবা নিউটনের গতিসূত্র পাশ কাটিয়ে
নোটখাতার একপাশে স্থান করে নিয়েছিলো
প্রেমসূত্র— 'নিয়তি'
 
তারপর যেটুকু জিকির করলে 
ঈশ্বর নেমে আসে বুকে; তারও অধিক স্মরেছি তোমার নাম–নীরবে, ধ্বনিতে।
 
একপড়ন্ত বিকেলে কোচিং ফেরত 
আমরা হয়ে উঠলাম একে অপরের;
জংধরা অনুভূতিগুলো সজীব হয়ে উঠলো মুহূর্তেই! 
পপকর্নের মতো ভালোবাসা ফোটতে থাকলো
তোমার দু'টি চঞ্চুতে, বিরামহীন।
আঙুলে আঙুল জড়িয়ে পায়ের স্কেল মাপতে মাপতে আমরা যেনো বিলীন হয়ে যাচ্ছিলাম প্রীতির সবুজে।
 
হৃদয়ের সহস্র আকুতি, সুখ-দুঃখের হিসাব নিকাশ
আর ফোনের রিচার্জবিল সমান্তরাল রাখার শপথ নিয়ে, আমরা আমাদের দূরত্বের সময়টুকুর নাম রেখেছিলাম 'বিশ্বাস'

শখ
অনেকের অনেক কিছু হওয়ার শখ থাকে। আমি জন্ম থেকেই কবিতান্ধ মানুষ। কর্পোরেট জগত আমাকে টানেনি, আমাকে টানেনি ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবার শখ। তবে আজকাল আমার বড্ড শখ হয় আপনার বাসার ওই ছিমছাম বেলকনি হতে!  
রোজ কতো শতোবার বেখেয়ালি মন খারাপ ভর করে আপনার উপর, হেমন্ত পেরিয়ে মনাকাশে আষাঢ় দেখা দিলেই, আপনাকে বেলকনি ছুঁতে পারে। ছুঁতে পারে টবে ঝুলে থাকা নীল অপরাজিতারা। মায়াবী মুখটাতে আনমনা ভাব নিয়ে আকাশে চোখ রাখা আপনাকে দেখে দেখে একদিন ফুলগুলো ঝরে গিয়েও কীযে শান্তি পাবে! ভাবতেই আমার এক্ষুনি মানুষজন্ম পাল্টে ফুল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে আপনার ওই ড্রেসিং টেবিলের আয়না হয়ে যেতে। যার সামনে দাঁড়িয়ে নির্বিঘ্নে সারিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন শ্রীহীন দেখানো যাবতীয় খুঁত। সবাই আপনার ছোঁয়া পায়, দেখতে পায় আয়নার মতো প্রাণভরে। কেবল মানুষ হওয়ার কারণেই মানুষকে এখানে অতো সহজে ছোঁয়া যায় না। মানুষের ছোঁয়াছুঁয়িতে নাকি পাপ থাকে, পাপ থাকে দৃষ্টি এবং অদৃশ্য কল্পনায় আপনাকে ভাবাতে। আমি জানি, সৌন্দর্য বিচারে আপনি টিথুনাসের আরোরা কিংবা আফ্রোদিতি নন। নিতান্তই মৃম্ময়ী কেউ। তবু কেনো আপনাকে দেখে আমার অতকিছু হবার শখ জাগে? বেলকনি অথবা নীল অপরাজিতা হবার শখ আমি অকপটে বলে ফেলেছি যদিও। কিন্তু বুকের খুব গভীর সুড়ঙ্গের ভেতর  লুকিয়ে রাখা একটি শখ আমাকে উস্কানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, অথচ হারিয়ে ফেলার ভয়ে শরমিন্দা মুখে কখনোই বলা হয়নি সে শখের কথা, বারবার আমি বেলকনি কিংবা নীলঅরাজিতার কথায় বলতে পেরেছি, বলতে পেরেছি আপনার স্পর্শ পাওয়া আরো অনেক কিছুর কথা। আমার নির্লজ্জ মনটার যে আপনাকে পাওয়ার বড্ড শখ, সে কথা আমার কখনোই বলা হয়ে উঠেনি...

ভালো থাকার রোজনামচা
চোখের আলপথ ধরে এখানে এখন আর স্বপ্ন আসে না।
তপ্ত জলের প্রতিটি ফোঁটায় ফোঁটায় এখানে ভেসে উঠে না আর কোনো হৃদয়পোড়ানো মানুষের মুখচ্ছবি।

এখানে এখন রোজ ভালোবাসা আসে,
এখানে এখন প্রতিটি মুহূর্তে ভালো থাকা আসে।
আগলে রাখার মানুষটা নেই জেনে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে এখানের চারপাশ, রাস্তায় হেঁটে চলা যান্ত্রিক মানুষ, গলির মোড়, এমনকি ভেন্টিলেটরে বাস করা আমাদের চড়ুইগুলোও।
রোজ শুভ্র সকালে তাদের মিষ্টি মধুর সাংসারিক ঝগড়াতে আমার চোখ মেলা হয়। ভীষণ মুগ্ধতায় মেলা হয় জানালার পর্দাগুলো।

ব্যস্ততা আর নির্জন অন্ধকারে ঘুরছে যাপনের কাটা। এখন ভালোবাসা হয় প্রতিটি বিষণ্ণ সন্ধ্যা,
অবান্তর চিন্তায় বাষ্পীভূত হতে হতে জুস হয়ে উঠা চা। ভালোবাসা হয়, রাতের তারাপথ— প্রশ্নবিদ্ধ অন্ধকার!

স্মৃতি রোমন্থনে কেটে গেছে গোটা কয়েক চৈত্র।
পূর্ণিমা তিথিতে আর কেউ বসেনি আমার পাশে,
হৃদয়াবেশে জড়িয়ে নেয়নি সরল ভালোবাসায়।
তবুও তো কেটে যাচ্ছে বেলা। কেটে যাচ্ছে প্রেমে।
জাগছে না চুমুর শিহরণ, মিথ্যা হাসির অভিনয়।
বুকফাটা আত্মচিৎকার— অভিমানী সব গান
এখানে এখন আর তোলে না করুণ রাগের সুর।
তপ্ত জলের প্রতিটি ফোঁটায় ফোঁটায় এখানে ভেসে উঠে না আর কোনো হৃদয়পোড়ানো মানুষের মুখচ্ছবি।



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন